অথচ—
একা একা খুব হাসল সত্যকাম আপনমনে। দুনিয়াটা যে কী হয়ে গেল! ওফ! যদি সত্যিই সুছন্দাকে বিয়ে করত অলক? তা হলে কী হত?
মনীষা জিজ্ঞেস করল, ওরকম হাসছ কেন?
খুব নেশা হয়েছে বুঝলে! দুনিয়াটাই অন্যরকম লাগছে।
অন্যরকম লাগানোর জন্যই তো নেশা করো তুমি।
তা ঠিক, তবে এতটাই অন্যরকম হওয়া ঠিক নয়।
অন্যরকম মানে কীরকম তা বুঝিয়ে বলো!
সত্যকাম গম্ভীর হয়ে গেল। আর কিছুই বলল না। সে মনে মনে সুছন্দাকে অলকের পাশে দাড় করাল। সুছন্দার মাথায় ঘোমটা, কপালে সিঁদুর। শিউরে উঠে সত্যকাম ছবিটা মুছে ফেলল।
০৬. বনানীর এক অদ্ভুত সুখকর অস্বস্তি
বনানীর এক অদ্ভুত সুখকর অস্বস্তি শুরু হল।
সৌরীন্দ্রমোহন, বনলতা, সোনালি সকলেই আজকাল কেমন যেন বিস্ময়ভরে এবং বিমূঢ়ের মতো তার দিকে তাকায়। তারা এমন কিছু দেখে বনানীর মধ্যে, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ঠিকে ঝি একদিন বলে উঠল, ও মা, এ যে অশৈলী কাণ্ড গো! সেই পেটমরা মেয়েটা যে একেবারে ধান ফুটে খই হল গো।
গয়লা দুধ দিতে এসে হাঁ করে তাকে দেখে। দেখে সৌরীন্দ্রমোহনকে খেউড়ি করতে এসে বিশে নাপিত। দেখে পাড়াপড়শি। প্রত্যেকের চোখেই অবিশ্বাস।
বনানীর আয়না লাগে না। অন্যের চোখেই সে আজকাল নিজেকে দেখতে পায়।
বাস্তবিকই আয়নার দিকে তাকায় না বনানী। কী দেখবে তা নিয়ে তার যত ভয়। সে যে বদলে গেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু বদলটা কেমন হল তা সে জানতে চায় না।
সোনালি পছন্দ করে না বলে সে পারতপক্ষে বারান্দায় যায় না। নিজেকে সে প্রাণপণে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই চেষ্টা করে। তার জীর্ণ শরীরে প্লাবন আসার এই ঘটনা তার কাছে এখনও তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। একা, ঘরে বসে মাঝে মাঝে নিজের স্তনভার অনুভব করতে করতে সে লজ্জায় ঘেমে ওঠে। স্নানঘরে পুরন্ত ঊরু, গভীর নাভি, মসৃণ হাতের গঠন দেখে সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয়। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ভগবান!
একদিন সোনালি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই সর্বনাশী রূপ এতকাল কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি রে হারামজাদি? তুই যে বহু সংসারে আগুন লাগাবি!
রূপ! রূপের কথা বনানী আজকাল বিশ্বাস করে।
সোনালি ফতোয়া দিল, খবরদার সাজবি না। লোকের সামনে ধিঙ্গির মা সিঙ্গি হয়ে গিয়ে দাঁড়াবি না।
বনানী ম্লান মুখে বলে, কারও সামনে যাই নাকি?
সোনালি বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে বলে, মনে কোনও পাপ নেই তো রে মুখপুড়ি? খুব সাবধান কিন্তু!
পাপ! বনানী পাপের কথা ভাবতে গিয়ে বড় অস্থির হয় মনে মনে। একা ঘরে টপ টপ করে চোখের জল পড়ে। পাপ! পাপ কি না তা তো সে জানে না। কিন্তু ওই যে একজন এসেছিল একদিন, তারপর বহুদিন আর আসেনি, ওই একজন লোক তার জীবনের সব এলোমেলো করে দিল। কেন এল ও? কিছুতেই যে বনানী ওকে মন থেকে, চোখ থেকে মুছে দিতে পারে না!
প্রায় ছ’মাস বাদে আবার বনানী পড়ল ভূমিকম্পে, ঝড়ে, বজ্রপাতে।
দুপুরবেলা। বুড়োবুড়ি ঘুমোচ্ছ। সোনালি ইস্কুলে। এমন সময় কলিং বেল-এর শব্দ।
বনানী ভাবল, পিয়োন বুঝি। নীচে নেমে দরজা খোলার আগে সে নিয়মমতো জিজ্ঞাসা করল, কে?
আমি। আমি অলক। কে, পিসি নাকি? শিগগির দরজা খোলো, ভীষণ খিদে পেয়েছে।
বনানী দরজা খুলল না। তাড়া-খাওয়া হরিণের মতো ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে পড়ে গেল ভীষণ জোরে।
মা গো!
শব্দে বনলতা নেমে এলেন, ও মা! এ কী রে? কী হল তোর?
ওদিকে কলিং বেল বেজে যাচ্ছিল, সঙ্গে অলকের গলা, কী হল? ও পিসি?
বনলতা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আয় দাদা, আয়। দেখ তো কী কাণ্ড! মেয়েটা আছাড় খেয়েছে, কী যে করি! হাত পা ভাঙল কি না।
হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, তিন জায়গাতেই প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিল বনানী। এমন ব্যথা যে তার মুখ নীল হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রণায়। তবু অলক ঢুকতেই সে ফের ‘মা গো’ বলে একটা আর্ত চিৎকার করে দুড়দাড় সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে এসে বুক চেপে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
সে পারবে না। সে আর বেঁচে থাকতে পারবে না। সে মরে যাবে।
বালিশে মুখ চেপে সে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। পাপ! পাপ! নিশ্চয়ই পাপ? সে যে মরে যাবে।
ঘরে কেউ এল। মাথায় হাত রাখল।
দিদিমার গলা পাওয়া গেল, খুব লেগেছে তোর? দেখি কোথায় লাগল। কাঁদছিস কেন? কাদিস। আমি ডাক্তার ডেকে পাঠাচ্ছি।
না। মাথা নাড়ল বনানী।
একটু বরফ লাগা ব্যথার জায়গায়। ফ্রিজ থেকে এনে দিচ্ছি।
লাগবে না দিদিমা। সেরে গেছে ব্যথা।
দিদিমা অর্থাৎ বনলতা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুই পালিয়ে আসছিলি কেন বল তো! ভয় পেয়েছিলি?
বনানী কী করে বলবে যে, হ্যাঁ ভয়, ভীষণ ভয়।
বনলতা একটু হেসে বললেন, মেয়েমানুষের ভয় থাকা ভাল। হড়াস করে যে দরজা খুলে দিসনি সেটা ভালই করেছিস। অলকের বদলে গুন্ডা বদমাশও হতে পারত তো।
বনলতা চলে গেলে একা ঘরে বনানী আক্রোশে পা দাপাতে দাপাতে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, গুডাই তো! গুন্ডা! ডাকাত! কেন এল ও? কেন এল? আমার যে পাপ হচ্ছে। আমার যে ভীষণ পাপ হবে। আমি এখন কী করব? ছাদে উঠে ঝাপ দেব? ফিনাইল খাব? মুখে কালি মাখব?
বনানী কিছুই করল না। শুধু কাদল। উপুড় হয়ে। অনেকক্ষণ।
তারপর তড়বড় করে উঠে বসল হঠাৎ। ভীষণ অবাক হয়ে ভাবল, আচ্ছা, এই যে আমি ওরকমভাবে পড়ে গেলুম, ব্যথা পেলুম, কাঁদলুম, কই ও তো একবারও এল না আমাকে দেখতে। বাড়ির ঝি বলে কি এতটাই ফেলনা! একটা মানুষ তো! সে ব্যথা পেলে একটু দেখতে আসতে নেই বুঝি?