তারপর বলল, উনি আমাকে বিয়ে করতেও চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। তারপর নানা খিটিমিটি, আমাদের ঝগড়া হয়ে গেল খুব। তারপর থেকেই রিলেশনটা বিটার। কিন্তু আমি সেটা ভুলে যেতে চাই। আমার অবস্থা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। তুমি যদি ওঁকে একটু বলল। একটা চান্স। আমি প্রাণপণে করব। তুমি বললেই হবে। তোমার বাবার কাছে তুমি দেবদূত।
অলক উঠল। একটিও কথা না বলে, বিদায়-সম্ভাষণ না করে বারান্দা থেকে নেমে গিয়ে তার স্কুটারে উঠল। স্টার্ট দিল। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, বলে দেখব।
মানুষের হীনতার কথা অলক জানে। উচ্চাকাঙক্ষার কথাও। মানুষ নিজেকে কতখানি হোট হয়ে যেতে দেয় তা সে দেখেনি কি? তাই সত্যকাম বা সুছন্দার ওপর তার ঘৃণা এল না। শুধু তার মনে হল কোনও কার্যকারণ সুত্রে সুছন্দা তার মা হয়। ভাগ্য ভাল, সত্যকাম তাকে ভোগ করার আগে বা পরে অলকের সঙ্গে তার কোনও দৈহিক সম্পর্ক হয়নি।
বাপ-ব্যাটায় বড় একটা দেখা হয় না, কথা হয় না। দিল্লি যাওয়ার আগে অলক একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখে গেল সত্যকামের টেবিলে, সুছন্দা কিছু প্রত্যাশা করে। ইন রিটার্ন।
সুছন্দা আবার নামতে পারল সিনেমায়। কিন্তু ঘটনা সেটা নয়। সুছন্দা বা সত্যকাম কেউ জানল না, এই ঘটনার পর অলক কেমন শুকিয়ে গেল ভিতরে ভিতরে। মেয়েদের সঙ্গে দৈহিক মিলনের সব সুযোগ সে ফিরিয়ে দিতে লাগল এরপর থেকে। ভীষণ ভয় হত তার। বড় সংকোচ।
নূপুর যথারীতি বিয়ে করল এক ডাক্তারকেই। ঝুমুর অনেক নাচিয়ে অবশেষে পাকড়াও করল এক মোটর পার্টসের ব্যাবসাদারকে। বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। সত্যকাম আজকাল প্রায় সবসময়েই বাইরে। মনীষা একা। বড্ড একা। এই ভ্যাকুয়াম কীভাবে ভরে তোলা যায় ভাবতে ভাবতে সে গান আর নাচ নিয়ে পড়ে রইল অহর্নিশি। তারপর তার মনে হল নির্জনতার ভূতটা বাড়ি থেকে যাচ্ছে না।
সুতরাং একদিন মনীষা তার ঠান্ডা, মূক ছেলের ওপর চড়াও হয়ে বলল, তুই ভেবেছিসটা কী শুনি?
অলক মায়ের দিকে তেমনি অকপটে চাইল, যেমনটা সে সকলের দিকে চায়।
মনীষা বলল, চাকরি তো ভালই করিস।
অলক একটু হাসল।
কী ঠিক করেছিস? বিয়ে করবি না নাকি? মা বাপের প্রতি কর্তব্য নেই?
অলক জবাব দিল না।
কিছু বলবি তো? হ্যাঁ কিংবা না!
অলকের মুখে সেই অর্থহীন মৃদু হাসি। চোখে একইরকম অকপট, প্রশ্নহীন, ভাষাহীন চাউনি। মনীষার মনে হয়, তার এই ছেলেটা মাঝে মাঝে সত্যিই বোবা হয়ে যায়। শুধু মুখে বোবা নয়, ওর মনটাও বোবা হয়ে যায় তখন। আর এইসব সময়ে নিজের ছেলের দিকে চাইলে মনীষার বুকের মধ্যে একটা ভয়ের বল লাফাতে থাকে। ধপ ধপ ধপ। কেবলই মনে হয়, ও একটা ঘষা কাচের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অস্পষ্ট, আবছা, রহস্যময়।
ছেলের সঙ্গে দূরত্বটাকে সত্যকাম জেনারেশন গ্যাপ বলে মেনেই নিয়েছে। নানা কাজকর্ম এবং ধান্দায়, সর্বোপরি নানা গোপন আনন্দে সে একরকম আলাদা করে নিতে পেরেছে নিজেকে। তার মতে, জীবনধারণ এই একবারই। পরজন্ম নেই, কর্মফল-টল সব বাজে কথা। ভগবান-টান নিয়ে সে কখনও ভাবেনি, তাই মানার প্রশ্নই ওঠে না। আর ওইভাবে নিজের ছেলের সঙ্গেও তার দুরত্বটা হয়েছে নিরেট।
কিন্তু মনীষাব তো তা নয়। সত্যি বটে, নূপুর আর ঝুমুরের সঙ্গে তার যে সখীত্ব ছিল, যে সমঝোতা, তার হাজার ভাগের একভাগও অলকের সঙ্গে নেই। কিন্তু সে কখনও হাল ছাড়ে না। মেয়ে দুটো পরের ঘরে চলে যাওয়ায় ফাঁকা বাড়িতে অলককে সে আজকাল অনেক বেশি লক্ষ করে। যত লক্ষ করে তত ভয় বেড়ে যায়।
সত্যকামের রোজগার বাড়ছে, খ্যাতি বাড়ছে, বাড়ছে চারিত্রিক বদনামও। পঞ্চাশ-ছোঁয়া এই বয়সটাও বড় মারাত্মক। ভাটির টান যখন লাগে তখন মানুষ ভোগসুখের জন্য পাগল হয়ে যায়। জানে তো আর বেশি সময় হাতে নেই, বেশিদিন আর নয় শরীরের ক্ষমতা। ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান হারিয়ে তখন সে কেবল খাই-খাই করে খাবলাতে থাকে চারপাশের ভোগ্যবস্তুকে। সত্যকাম চুলে কলপ দিচ্ছে, রংচঙে জামা গায়ে চড়াচ্ছে, সেন্ট মাখছে গায়ে।
মনীষা বিষ-চক্ষুতে নীরবে দেখে যাচ্ছে সব কিছু। দুজনের মধ্যে অসীম ব্যবধান তৈরি হচ্ছে অলক্ষে।
সত্যকাম লাইফস্টাইল পালটাচ্ছে বলে আজকাল সন্ধের পর বাড়িতে থাকলে একটু ড্রিংকস নিয়ে বসে এবং মনীষাকেও ডেকে নেয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে ড্রিংক করা বেশ একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে।
মনীষার ব্যাপারটা খারাপও লাগে না। সে অল্পই খায়। সত্যকাম নেশা করে।
একদিন এরকম ড্রিংক করার মুখে সত্যকাম বলল, তোমাকে আজকাল খুব ব্রুডিং মুডে দেখি।
মনীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দেখো তা হলে? যাক বাবা, বাঁচা গেল! সা
মথিং রং?
না। সবই ঠিক আছে।
অলককে নিয়ে কোনও প্রবলেম নয় তো?
মনীষা কেন কে জানে সত্যকামের সঙ্গে অলকের বিষয়ে কথা বলতে ভালবাসে না। তার মনে হয় এ বিষয়ে আলোচনা করার যথার্থ অধিকার সত্যকামের নেই। কেন যে এরকমটা মনে হয় তার ব্যাখ্যা মনীষা কখনও করতে পারবে না।
সে বলল, না না। অলককে নিয়ে প্রবলেম হবে কেন?
অলক প্রবলেম হলেই বা সত্যকামের কী, না হলেই বা কী? সে তরল আনন্দে ভেসে গেল।
কিন্তু সেই রাতে শোয়ার সময় হঠাৎ সত্যকামের মনে পড়ল, একসময়ে সে সুছন্দার সঙ্গে অলককে ভিড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। এমনকী সুছন্দাকে পুত্রবধু করার প্রস্তাবও দিয়েছিল সে।