সুতরাং সুছন্দার কাছে প্রস্তাবটা গেল এবং সে ও তার আধুনিক মনোভাবাসম্পন্ন সংস্কারমুক্ত মা-বাবা উৎসাহের সঙ্গেই সম্মতি দিল। লোকেশন বাঁকুড়া, কালিম্পং আর হরিদ্বার। তিনমাস শুটিং-এর পর সুছন্দা এতটাই বদলে গেল বা প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে উঠল যে চেনা লোকেরাও আর যেন এই অহংকারী, বাচাল, ছলবলে, পাকা ও ন্যাকা মেয়েটাকে চিনে উঠতে পারে না। সেই সিরিয়াস, লাজুক, রোমান্টিক, স্বল্পভাষী মেয়েটা সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ।
বিষাক্ত চোখে মনীষা কয়েকদিন নাচের ক্লাসে সুছন্দাকে খুঁজল। পেল না। সুছন্দা পাকাপাকিভাবে তার স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। হন্যে হয়ে ঘুরছে ছবির কন্ট্রাক্ট পাওয়ার জন্য। পার্টি দিচ্ছে ঘন ঘন। বোম্বে ঘুরে এল কয়েকবার।
শীতের শেষ রাতে লেক-এর জলে কোনও সাঁতারুই থাকে না। যারা রোয়িং করে তারাও আসে আর-একটু পরে। এই শেষ রাতে আসে শুধু অলক। প্রথম কিছুক্ষণ দুরন্ত দু’হাতে বৈঠা মেরে উন্মত্ত গতিতে রোয়িং করে নেয় সে। তারপর কুয়াশায় আধো-আড়াল চারিদিককার এক মোহময়তা ঘনীভূত হতে থাকে জলে। নীল জলে সেই ভোরবেলাকার আবছায়া, কুয়াশা, চঁাদ বা তারা থেকে চুরি করে-আসা মায়াবী আলোয় তৈরি হতে থাকে প্রিয় বিভ্রম। একসময়ে দীর্ঘ ও সরু, তিরের মতো বেগবান নৌকোটিকে সে থামায়। নিঃশব্দে গ্রিজমাখা শরীরে নেমে যায় জলে।
রোজ নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে এইরকম নির্জনতায়, এমনই বিজনে জল থেকে উঠে আসে জলকন্যা।
সেদিনও অলক দু’হাতে জল কেটে শব্দহীন ঘুরে বেড়াচ্ছিল অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। আকস্মিক পিছনে জলের এক মৃদু আলোড়ন টের পেল সে।
অলক জলের মধ্যে লাটিমের মতো একপাক ঘুরল তিরবেগে।
বৈঠক জবাবর সঙ্গে কের। কিছু
সরু একটা সাদা রোয়িং বোটের মুখ কুয়াশা চিরে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার ওপর জলকন্যা। সাদা, পরির মতো পোশাক, বৈঠায় দুই গোলাপি হাত।
জলকন্যা?
জলকন্যা মানুষীর গলায় ডাকল, অলক!
বিভ্রম ভেঙে গেল অলকের। কিছুক্ষণ খুবই হতাশ হয়ে চেয়ে রইল সে।
অলক! তোমার সঙ্গে যে ভীষণ দরকার। প্লিজ!
অলক জবাব দিল না। তবে ধীর হস্তক্ষেপে সাঁতরে এসে নিজের নৌকায় উঠল। কয়েক লহমায় বৈঠা চালিয়ে নৌকো এনে ভিড়িয়ে দিল ক্লাবের ঘাটে, পিছনের দিকে দৃকপাতও না করে ভিতরে ঢুকে ভেজা পোশাক পালটে যখন বারান্দায় এল, তখন সুছন্দা তার জন্য একটা কঁকা টেবিলে অপেক্ষা করছে। শীতের শেষরাতে তার এই অস্বাভাবিক আবির্ভাব নিয়ে অলক কোনও প্রশ্ন করল বলে কেমন অস্বস্তি বোধ করছিল সুছন্দা।
তবে অলক সুছন্দার দিকে শান্ত, গভীর ও প্রায় অপলক এক জোড়া চোখে চেয়ে রইল।
গত কয়েকমাসে পুরুষের চোখের নানাবিধ চাউনিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সুছন্দা। তবু অলকের ওই নিরুদ্বেগ, ভাষাহীন, প্রশ্নহীন চোখ তাকে লেসার বিমের মতো স্পর্শ করেছিল হয়তো। বারবার সে অস্বস্তিতে মাথা নুইয়ে বা অন্যদিকে চেয়ে এড়াতে চাইছিল সেই চাউনি।
অবশেষে সে বলল, আমি শুনেছিলাম জলের মধ্যে থাকলে নাকি তুমি অন্যরকম হয়ে যাও। আজ দেখলাম সত্যি। মনে হচ্ছিল তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সাঁতরাচ্ছ।
অলক একটু হাসল মাত্র। জবাব দিল না। সে জানে এ কথা বলতে সুছন্দা আসেনি।
সুছন্দা তার কার্ডিগানের দুটো বোম খুলল, ফের একটা লাগাল। তারপর নিজের চুলে একটুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলল, তুমি আজ সকালের গাড়িতে দিল্লি যাচ্ছ শুনে ভোরবেলা এখানে এসে তোমাকে ধরেছি। আমার ভীষণ বিপদ।
অলক তেমনি এক অকপট চাউনিতে চেয়ে আছে।
সুছন্দা মাথা নুইয়ে বলল, আমার ভীষণ খারাপ সময় যাচ্ছে জানো তো! ভীষণ খারাপ। কেউ আমাকে চাইছে না। বোম্বে কলকাতার কোনও প্রোডিউসারই কন্ট্রাক্ট দিচ্ছে না। ঘোরাচ্ছে। অথচ ফিল্ম কেরিয়ার ছাড়া আর কিছু আমি ভাবতেও পারছি না।
অলক শান্ত স্বরে বলল, চা খাবে?
খাব।
অলক চায়ের কথা বলে এসে ফের বসল।
সুছন্দা খুব আকুল গলায় বলল, অলক, প্লিজ আমার একটা উপকার করবে? তোমার বাবা একজন বিগ প্রোডিউসার পেয়ে গেছেন। অনেক টাকার প্রোডাকশন। বিগ বাজেট। আমি খবর পেয়েছি একটা ভাল লোল আছে, এখনও কাস্টিং হয়নি।
অলক তেমনি অকপটে চেয়ে থাকল। চা এল, সে একটা চুমুক দিয়ে ফের মুখ তুলল। আবার চেয়ে রইল।
সুছন্দা মুখ নামিয়ে বলল, জানি তুমি কী ভাবছ। তোমার বাবাই আমাকে সিনেমায় নামিয়েছিলেন। সুতরাং তার কাছে আমি নিজেই অ্যাপ্রোচ করতে পারি। কিন্তু তুমি জানো না যে, আমাদের রিলেশনটা ঠিক আগের মতো নেই।
কেন?
সামথিং হ্যাপেনড়। যদি শুনতে চাও তো বলতে পারি। শুনবে?
যদি বলতে চাও।
হি হ্যাড এ ক্রাশ অন মি। ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। আমি বাধা দেওয়ায় খেপে যান।
কথাটা যে মিথ্যে তা সুছন্দার মুখে-চোখেই লেখা আছে। অলক অনেকদিন আগেই টের পেয়েছিল, তার বাবা সত্যকাম প্রায় বিনা চেষ্টাতেই সুছন্দাকে যেমন পেতে চেয়েছিল তেমনই পেয়ে গেছে। কিছু বাকি নেই।
অলক কথা না বলে চায়ে দুটো-একটা মৃদু চুমুক দিল।
সুছন্দা চোখভরা জল নিয়ে বলল, তুমি বোধহয় বিশ্বাস করলে না!
অলক ফের হাসল।
সুছন্দা খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, আচ্ছা, স্বীকার করলাম উই হ্যাড অ্যাফেয়ার্স।
অলক খুব ধীরে তার চায়ে আর-একবার চুমুক দিল। যখন মুখ তুলল তখন তার উজ্জ্বল মুখ ধূসরতায় মাখা।
সুছন্দা মাথা নিচু করে বসে রইল। চোখ থেকে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছিল টেবিলে। চায়ের কাঁপেও। সুছন্দা তার রুমালে চোখ মুছল অনেকক্ষণ বাদে। নিজের কপালটা টিপে ধরে বসে রইল খানিকক্ষণ।