শুনে বনানীর চোখ কপালে উঠল। তাকে দেখে ছেলেরা সিটি দেবে! তাকে দেখে!
সে দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে একা একা হিঃ হিঃ করে পাগলের মতো হাসতে লাগল। মাগো! সোনালি পিসিটা একদম পাগল। একদম পাগল। এ মা! কী বলে রে!
শুক থেকে প্রজাপতির জন্ম যেমন অদ্ভুত তেমনই অদ্ভুত কিছু ঘটতে লাগল বনানীর শরীরেও। ঝলঝলে সেই রোগা শরীরে কোথা থেকে ধীরে ধীরে জমে উঠছিল পলির স্তর, উর্বরতা।
০৫. দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক ওয়ার্ক-আউট
দাদা, একে চিনিস?
অলক দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক ওয়ার্ক-আউটের পর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সটান শুয়ে পড়েছিল। চোখ জুড়ে আসছিল অবসাদে। ঝুমুরের ডাকে চোখ তুলল। ঝুমুরের সঙ্গে একটি মেয়ে।
তো! ও তোর সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
অলক ভাল করে তাকিয়ে বুঝল, বাজে কথা। মেয়েটির চোখে বিস্ময় বা কৌতূহল নেই। আছে একটু অনিশ্চয়তা, দ্বিধা, সংকোচ। তবে মেয়েটি সুন্দরী। বোধহয় নাচে। বেশ ছমছমে শরীর। হান্ড্রেড পারসেন্ট ফিট।
ও। বসুন।
মেয়েটি বসল না। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঝুমুর বলল, ওর নাম সুছন্দা। দারুণ নাচে।
অলক মেয়েটিকে দেখছিল। দেখার জন্য নয়, বোঝবার জন্য। কিছু কিছু মেয়ে নিশ্চয়ই আছে যারা অলকের সঙ্গে আলাপ করতে চায়, ভাব করতে চায়, প্রেম-ভালবাসা গোছের কিছু করতে চায়। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখে মনে হয়, এ তাদের দলে নয়। একে ধরে আনা হয়েছে।
অলক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, আমি ভীষণ টায়ার্ড। প্লিজ সুছন্দা, কিছু মনে করবেন না।
সুছন্দা কিছু মনে করল কি না কে জানে, তবে ঝুমুর ভীষণ অপমান বোধ করে বলে উঠল, ও কী রে দাদা! একটু আলাপ কর। তোকে দেখতেই এল!
অলক মুখ তুলে সুছন্দার দিকে মৃদু হেসে বলল, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ জমবে না। একটু পরেই কথা ফুরিয়ে যাবে। আলাপ করতে একটা টিউনিং দরকার। আমার সঙ্গে আপনার সেই টিউনিং হবে না।
মেয়েটা লাল হল, কাঁদো কাঁদো হল, তারপর একটিও কথা না বলে চলে গেল।
কী করলি দাদা! ছিঃ!–ধমক দিল ঝুমুর।
অলক কথা খুব কম বলে কিন্তু সুছন্দাকে অত কথা একসঙ্গে বলে সে নিজেই অবাক হয়েছিল। এত কথা তো তার আসে না কখনও। বরং মেয়েটিই একটি কথাও বলেনি।
সুছন্দাকে ভুলে যেতে অলকের বেশি দিন লাগেনি। সারা বছর তার হাজারটা কমপিটিশন, ট্রায়াল, মিট, কোচিং। হাজারটা মুখের সঙ্গে রোজ মুখোমুখি হতে হয়। কত মনে রাখা যায়?
কয়েক মাস আগে লেক-এ একটা ওয়াটার ব্যালের রিহার্সাল চলছিল। অলক জলের ধারে বসে একটা কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছে আর আলগা চোখে রিহার্সাল দেখছে। এমন সময় ব্যালের গ্রুপ থেকে একটা মেয়ে দল ভেঙে উঠে এসে হেড গিয়ারটা খুলে অলকের দিকে চেয়ে বলল, চিনতে পারছেন?
অলক অবাক হল না। একটু হাসল। বলল, আপনি না নাচতেন?
এখনও নাচি। মনীষাদির কাছে। এ বছর ওয়াটার ব্যালেতেও নেমেছি।
বাঃ বেশ!
বলে অলক আবার কোল্ড ড্রিংকসটা মুখে তুলল।
মেয়েটা তার ভেজা কস্টিউম নিয়েই একটা ফাঁকা চেয়ারে মুখোমুখি বসে বলল, আপনি অত ঠোঁটকাটা কেন?
আমি!–বলে অলক খুব ভাবতে লাগল।
মেয়েটি হাসল। বলল, অবশ্য কথাগুলো খুব সত্যি। পরে ভেবে দেখেছি, টিউনিং না থাকলে কথা আসে না।
অলক সংক্ষেপে বলল, হুঁ।
এইভাবে সুছন্দার সঙ্গে আলাপ। আবার আলাপও ঠিক নয়। কারণ অলককে সাঁতার উপলক্ষে দু’দিন বাদেই চলে যেতে হল বোম্বাই। ফিরে এসে পনেরো দিনের মাথায় হুবহু একভাবে দেখা হয়ে গেল।
কোথায় গিয়েছিলেন বলুন তো? অনেক দিন দেখিনি আপনাকে।
বোম্বাই।
সাঁতার দিতে?
ওই আর কী।
সুছন্দা হাসল, আপনার সঙ্গে সত্যিই আমার টিউনিং হচ্ছে না।
জবাবে শুধুই একটু হাসল অলক।
আর তিনদিন বাদে আমাদের প্রোগ্রাম। আসবেন?
দেখি যদি থাকি কলকাতায়।
অলক থেকেছিল। ওয়াটার ব্যালেটা উতরেও গিয়েছিল ভাল। কিন্তু অত রং আর রোশনাইতে একগাদা মেয়ের ভিড়ে সুছন্দাকে সে চিনতেই পারল না।
পরদিন শোওয়ার সময় ঝুমুর রীতিমতো ঝাঁঝালো গলায় বলল, সুছন্দা খুব তোর কথা বলছিল।
ও।
কোথায় আলাপ হল বল তো!’ লেকে সেই ওয়াটার ব্যালেতে, না?
হুঁ।
কী মেয়ে বাবা!
কথাটা কেন বলল ঝুমুর, তা বুঝল না অলক। তবে প্রশ্নও করল না। ঘুমিয়ে পড়ল।
সত্যকাম একদিন রাত্রে ঘোষণা করল, দারুণ প্রোডিউসার পেয়ে গেছি মনীষা! স্টোরিও এসে গেছে। ফাটিয়ে দেব। আই নিড সাম নিউ ফেসেস। হেলপ করবে?
করব না কেন? কেমন রোল?
হিরোইন।
মনীষা নির্বিকার মুখে বলল, ঝুমুরকে নাও না! মানাবে।
আরে যাঃ। ও হয় না।
তা হলে নুপুর?
তোমার সেই ছাত্রীটি সুছন্দা! ওকে বলে দেখোনা!
মনীষা ঠোঁট ওলটাল। তারপর বলল, সুছন্দাকে খুব পছন্দ দেখছি! কখনও ছেলের বউ করতে চাইছ, কখনও নায়িকা।
শি ফিটস দা রিকোয়ারমেন্টস।
মনীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই দেখছি।
সংসারের সম্পর্কগুলো এমন সব সূক্ষ্ম ভারসাম্যতার ওপর নির্ভর করে যে, একটা মাছি বসলেও পাল্লা কেতরে যায়। সুছন্দার প্রতি সত্যকামের এই পক্ষপাত মনীষার সংসারে একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারত। কিন্তু মনীষা আর সত্যকামের সম্পর্ক অত সূক্ষ্ম জিনিসের ওপর নির্ভরশীল নয়। বিভিন্ন কারণে তাদের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে অনেকটা বোদা, ভোতা এবং ঈষৎ নিরুত্তাপ। সত্যকামের নারীঘটিত অ্যাডভেঞ্চারের কথা মনীষা জানে বা আঁচ করে। আবার মনীষারও কিছু পরপুরুষের ব্যাপার ছিল, যা হাতেনাতে ধরেও সত্যকাম তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সম্ভবত সেগুলো সঞ্চয় করে রেখেছে দরকারমতো কাজে লাগাবে বলে। দুজনের কাছেই দু’জনের গুপ্ত কথা সঞ্চিত থাকায় কেউ কাউকে ঘাটায় না বিশেষ।