বনানী পড়ল বশিষ্ঠর ভাগেই। ছোট ভাই কেষ্টর ভাগে পড়ল লক্ষ্মীপিসি। লক্ষ্মীমন্ত একটা সংসারের এমন ছিরি হল ক’দিনের মধ্যেই যে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
লাকড়িঘরের পাটাতনের ঠাইটুকু বনানীর রয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু খাটুনি বাড়ল বেদম। তার ওপর অবস্থা পড়ে যাওয়ায় বশিষ্ঠর গিন্নি কালী ঠাকরুন রোজ বলা শুরু করল, ওই অলক্ষুনেটাকে তাড়াও। বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে কে? আর কি আমাদের সেই অবস্থা আছে?
ভয়ে বনানী নিজে থেকেই খাওয়া কমাল। শরীরে যতদুর দেয় ততদুর বা শরীর নিংড়ে তার চেয়েও বেশি খাটতে লাগল। ধান আছড়ানোে অবধি বাদ দিল না।
চিনি-বউ বলল, তুই এখানে টিকতে পারবি না। আমিও বরের কাছে বর্ধমানে চলে যাচ্ছি। তুইও পালা।
কোথায় পালাব? আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই।
চিনি-বউ একটু ভেবে বলল, আচ্ছা দাঁড়া। রোববার দাদা আসবে। একবার পরামর্শ করি দাদার সঙ্গে।
শুভ্র দাস রোববারে এল এবং চিনি-বউয়ের সঙ্গে তার কথাও হল।
বনানী দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছিল উঠোনে।
অবশেষে চিনি বউ ডাকল। আর সেইদিনই শুভ্রদাদাব সঙ্গে বনানী চলে এল কলকাতায়। ঝি-গিরি করতে।
বাবাকে বলে এসেছিল রওনা হওয়ার আগে।
বাবা উদাস মুখে বলল, তুই তো মরতেই জন্মেছিস। যা গিয়ে দেখ বাবুটি কি ডাক্তার?
হ্যাঁ গো বাবা, বড় ডাক্তার।
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোর চিকিচ্ছে করবে?
করতে পারে।
বশিষ্ঠ তোকে রাখবে না, আমাকেও বলেছে। এ বরং ভালই হল।
ভাল হয়েছিল কি না কে জানে। বাবার জ্যোতিহীন চোখ, পাঁশুটে ক্ষয়া মুখখানা ভাবতে ভাবতেই সে শুভ্রবাবুর সঙ্গে গাঁ ছেড়ে কলকাতায় এল। খুপরি খুপরি তিন-চারখানা ঘর নিয়ে বাসা। ভারী কষ্ট এখানে মানুষের। সবচেয়ে বড় কষ্ট বোধহয় ছোট্ট জায়গার মধ্যে নিজেকে আঁটিয়ে নেওয়া।
তবু তা একরকম সয়ে নেওয়া যায়। সিঁড়ির তলায় সেই চটের বিছানা, কলঘরে স্নান, ছাদে উঠে কাপড় শুকোনো এসব অভ্যাস করে নিতে সময় লাগত না। কিন্তু ততটা সময় দিল কই শুবাবুর বউ কল্যাণী? কল্যাণী বউদি প্রথম দিনই বলে ফেলেছিল, এ তো টি বি রুগি, কোখেকে ধরে আনলে?
নাক সিঁটকে সেই ঘেন্নার চাউনি কি সহজে ভোলা যায়? বনানী সিঁটিয়ে গেল সেই চোখের সামনে। শরীর নিয়ে তার নিজেরই লজ্জার শেষ নেই। তাতে আবার মুখের ওপর খোঁটা।
দিন সাতেকের মাথায় তাকে নিয়ে শুভ্র আর কল্যাণীর মধ্যে বেশ মন কষাকষি বেধে গেল। বাড়িতে আরও লোক ছিল। শুভ্রবাবুর বাবা আর মা। বনানীর ব্যাপারে তারাও খুশি নয়।
মুশকিলে পড়ল শুভ্র। বনানীকে ফের চাঁপারহাটে রেখে আসতে হবে। আর বনানীর সমস্যা হল, চাঁপারহাট গিয়ে সে ফের উঠবে কোথায়? তার যে সেখানে আর জায়গা নেই।
ঠিক এইসময়ে শুভ্র একদিন পাশের বাড়িতে বনানীকে নিয়ে তার সমস্যার কথা গল্প করেছিল। সে-বাড়িতে একটি আইবুড়ো মেয়ে আছে, ভারী খেয়ালি। সে বলল, রোগ-টোগ যদি না থাকে তবে আমাদের বাড়িতে দিতে পারো। মা-বাবার একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়। তবে রোগ থাকলে দিয়ে না।
বনানীর বাস উঠল আবার। ঠেক থেকে ঠেক ঘুরে ঘুরে তার মনের মধ্যে এখন জন্তুর মতো একটা ভয় দেখা দিয়েছে। শুধু বেঁচে থাকাটাই যে এ দুনিয়ায় কী কঠিন ব্যাপার! মাথার ওপর একটা ঢাকনা, দুবেলা দুটো বাসিপাতা যা হোক জুটে যাওয়া, এটাই এক মস্ত প্রাপ্তি তার কাছে। ভগবানকে সে কদাচিৎ ডাকে। তার মনে হয়, ভগবান এক মস্ত মানুষ, তার মতো গরিব ভিখিরির ডাকে কান দেবেন না। কিন্তু এইবার শুভ্রবাবুদের বাসার পাট চুকে যাওয়ার সময় সে এক দুপুরে ভগবানকে খুব ডাকল, এবার যে বাড়ি যাচ্ছি তারা যেন আমায় ঘেন্না না করে, হে ভগবান।
পুঁটুলি বগলে নিয়ে সে যখন সৌরীন্দ্রমোহনের বাড়িতে ঢুকল তখন প্রথম দর্শনেই বাড়িটা তার ভাল লেগে গেল। কম লোক, ঠান্ডা শব্দহীন সব ঘর, বেশ নিরিবিলি। বুড়োবুড়ি আর তাদের আইবুড়ো একটা মেয়ে। বড় ভয় করছিল বনানীর। তাকে এরা পছন্দ করবে তো! যদি না করে তা হলে সে কোথায় যাবে এর পর?
পিঠে কুঁজওয়ালা মেয়েটাকে দেখে বুক শুকিয়ে গেল বনানীর। চোখে খর দৃষ্টি, মুখটা থমথমে গম্ভীর, কেমন যেন।
সোনালি তখন সবে স্কুল থেকে ফিরেছে। মেজাজটি কিছু গরম। বেশ ঝঝের গলায় বলল, যদি তোর গলা কেটে ফেলি তা হলে টু শব্দ করবি?
বনানী এর জবাবে কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, না।
যদি চিমটি কাটি তা হলে চেঁচাবি?
বনানী ভয়ে ভয়ে বলল, না তো!
যদি কাতুকুতু দিই তা হলে কখনও হসবি?
বনানীর মাথা গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। গায়ে ঘাম দিচ্ছে। কী পাগলের পাল্লাতেই পড়া গেছে। সে ফের মাথা নেড়ে বলল, না।
এ বাড়িতে থাকতে গেলে রোজ পেস্ট আর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে হবে, রোজ সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে মান করতে হবে, নোংরা থাকলে কাপড়কাচার মুগুর দিয়ে মাথায় মারব, বুঝলি?
হ্যাঁ।
মাথায় কহাজার উকুন নিয়ে এসেছিস?
বেশি নয়।
ইস, বেশি আবার নয়! ওই উলোঙ্কুলো চুলে লাখে লাখে উকুন আছে। মুখে মুখে কথা বলার অভ্যাস নেই তো? চোপা করলে চুলের মুঠি ধরে ছাদে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দেব।
এবার বনানী ততটা ভয় পেল না। তার মনে হল যতখানি তর্জন-গর্জন হচ্ছে ততদুর খারাপ এ মেয়েটা নয়। সে হঠাৎ হেসে ফেলে বলল, আচ্ছা।
চুরি করে খাস?
না তো।
পয়সা-টয়সা সরাবি না তো?
না।
সব তাতেই যে সায় দিয়ে যাচ্ছিস? পরে যদি স্বরূপ বেরোয় তখন দেখবি মজা।