- বইয়ের নামঃ সাঁতারু ও জলকন্যা
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. জলের ঐশ্বর্য
জলের ঐশ্বর্যকে যেদিন প্রথম আবিষ্কার করেছিল অলক সেদিন থেকেই ডাঙাজমির ওপরকার এই বসবাস তার কাছে পানসে হয়ে গেল। একদা কোন শৈশবে প্লাস্টিকের লাল কোনও গামলায় কবোষ্ণ জলে তাকে বসিয়ে দিয়েছিল মা। জলের কোমল লাবণ্য ঘিরে ধরেছিল তাকে। সেই থেকে জল তার প্রিয়। বাড়ির পাশেই পুকুর, একটু দুরে নদী। ভাল করে হাঁটা শিখতে না শিখতেই সে শিখে ফেলল সাঁতার। সুযোগ পেলেই পুকুরে ঝাপ, নদীতে ঝাপ। মা’র বকুনি, তর্জন-গর্জন সব ভেসে যেত জলে। যে গভীরতা জলে সেরকম গভীরতা আর কিছুতেই খুঁজে পেত না অলক। খুব অল্প বয়সেই সে আবিষ্কার করেছিল জলের সবুজ নির্জনতাকে। নৈস্তব্ধকে।
জল থেকেই সে তুলে এনেছে বিস্তর কাপ আর মেডেল! মুর্শিদাবাদে গঙ্গায় দীর্ঘ সাঁতার, পক প্রণালীর বিস্তৃত জলপথ, জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতা, সব জায়গাতেই অলকের কিছু না কিছু প্রাপ্তি হয়েছে। রাজ্যের হয়ে সে বেশ কিছুদিন খেলেছে ওয়াটারপোলো। ঘরে আলমারির পর আলমারি ভর্তি হয়েছে নানাবিধ পুরস্কারে। কিন্তু অলক, একমাত্র অলকই জানে, কাপ-মেডেলের জন্য কখনওই সে সাঁতার কাটেনি। জলের মধ্যেই তার জগৎ, জলের মধ্যেই তার আত্ম-আবিষ্কার, জলই তার দ্বিতীয় জননী।
জলের কাছে সে শিখেছেও অনেক। তার স্বভাব শান্ত, সে ধৈর্যশীল, কম কথার মানুষ।
তার ছেলেবেলায় একদিনকার একটি ঘটনা। বাড়ির একমাত্র টর্চটাকে কে যেন ভেঙে রেখেছিল। মা তাকেই এসে ধরল, তুই ভেঙেছিস।
অলক প্রতিবাদ করতে পারল না। সে ধরেই নিয়েছিল সত্যি কথা বললেও মা তাকে বিশ্বাস করবে না। একজনের ঘাড়ে টর্চ ভাঙার দায়টা চাপানো দরকার। সুতরাং সে দু-চার ঘা চড়-চাপড় নীরবে হজম করল, মাথা নিচু করে সয়ে নিল ঝাল বকুনি। ব্যাপারটা মিটে গেল।
পরদিনই অবশ্য টর্চ ভাঙার আসল আসামি ধরা পড়ল। তার দিদি। তখন মা এসে তাকে ধরল, কাল তা হলে বলিসনি কেন যে, তুই ভাঙিসনি?
অলক এ কথারও জবাব দিল না।
মা খুব অবাক হল। চোখে শুধু বিস্ময় নয়, একটু ভয়ও ছিল মায়ের। যাকে বোঝা যায় না, যে কম কথা বলে এবং যার অনেক কাজই স্বাভাবিক নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না, তার সম্পর্কে আশেপাশের লোকের খানিকটা ভয় থাকে। কী ছেলে রে বাবা!
অলককে নিয়ে মা আর বাবা দুজনেরই নানা দুশ্চিন্তা ছিল। শান্ত, প্রতিবাদহীন এই ছেলেটিকে তাদের বুঝতে অসুবিধে হত। তার বায়না নেই, খিদে পেলেও মুখ ফুটে খেতে চায় না, সাতটা কথার একটা জবাব দেয়।
পাড়ায় সোমা নামে একটি পাজি মেয়ে ছিল। একদিন সে এবং তার বাড়ির লোকেরা শশারগোল তুলল, অলক নাকি সোমাকে একটা প্রেমপত্র দিয়েছে। খুব অশ্লীল ভাষায়। এই নিয়ে। সারা পাড়া তুলকালাম। সোমার বাড়ি ঝগড়ুটে বাড়ি বলে কুখ্যাত। পুরো পরিবার এসে চড়াও হয়ে অলক এবং তার বাপ-মাকে বহু আকথা-কুকথা শুনিয়ে গেল, পাড়ার লোকও শুনল ভিড় করে। অলক জবাব দিল না, একটি প্রতিবাদও করল না। পরে তার বাবা রাগের চোটে একটা ছড়ি প্রায় তার শরীরে ভেঙে ফেলল পেটাতে পেটাতে। তারপর হাল ছেড়ে দিল।
পরে যখন চিঠির রহস্য ফাঁস হয় তখনও অলক নির্বিকার। সেই চিঠি অলকের হাতের লেখা নকল করে লিখেছিল সোমা নিজেই। কেন লিখেছিল তা সে নিজেও জানে না। বয়ঃসন্ধিতে ছেলে-মেয়েদের মন নানা পাগলামি করে থাকে। সোমা সম্ভবত অলকের প্রেমে পড়ে থাকবে এবং তার মনোযোগ আকর্ষণের নিরন্তর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ওইভাবে প্রতিশোধ নেয়। একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল ঠিকই এবং সেইজন্য সে পরে অনেক চোখের জল ফেলেছে।
কিন্তু যার জন্য এত কিছু, সে সুখে দুঃখে নির্বিকার সাঁতরে চলেছে পুকুরে, নদীতে, সমুদ্রে কিংবা বাঁধানো সুইমিং পুল-এ। ডাঙায় যা ঘটে তার সবকিছুই সে ধুয়ে নেয় তার প্রিয় অবগাহনে। জলই তাকে দেয় আশ্রয়, ক্ষতস্থানে প্রলেপ, বেঁচে থাকার রসদ।
এক-একদিন খুব ভোরবেলা কুয়াশামাখা আবছা আলোয় একা লেকের জলে রোয়িং করতে করতে তার আদিম পৃথিবীর কথা মনে হয়। আগুনের গোলার মতো তপ্ত পৃথিবীর আকাশে তখন কেবলই পরতের পর পরত জমে যাচ্ছে নানা গ্যাস ও বাষ্প! কত মাইল গভীর সেই মেঘ কে বলবে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমা হয়েছিল মেঘ। তারপর ক্রমে ক্রমে জুড়িয়ে এল পৃথিবী। একদিন সেই জমাট মেঘ থেকে শুরু হল বৃষ্টি। চলল হাজার হাজার বছর ধরে। বিরামবিহীন, নিচ্ছিদ্র। জল পড়ে, তৎক্ষণাৎ বাষ্প হয়ে উড়ে যায় আকাশে, ফের জল হয়ে নামে। কত বছর ধরে চলেছিল সেই ধারাপাত কে জানে। তবে সেই বৃষ্টিও একদিন থামল। পরিষ্কার হয়ে গেল আকাশ। দেখা গেল সমস্ত পৃথিবীটাই এক বিশাল জলের গোলক। তারপর ধীরে ধীরে জল সরে যেতে লাগল নানা গহ্বরে, ঢালে, নাবালে। মাটি আর জলে আর রোদে শুরু হল প্রাণের এক বিচিত্র লীলা। উদ্ভিদে, জলজ প্রাণীতে, স্থলচরে সেই প্রাণের যাত্রা চলতে লাগল। অলকের মনে হয়, সেই আদিম প্রাণের খেলায় সেও ছিল কোনও না কোনওভাবে। তার রক্তে, তার চেতনায় সেই পৃথিবীর স্মৃতি আছে। সে কি ছিল জলপোকা? শ্যাওলা?
খেলোয়াড়দের নানারকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে থাকে একটু আলাদা রকমের পৌরুষের বোধ, কিছু গ্ল্যামারও। মোটামুটি নামকরা একজন সাঁতারু হওয়া সত্ত্বেও অলকের এইসব বোধ নেই। সে যে একজন সাঁতারু এ কথাটাই তার মনে থাকে না। মাঝে-মধ্যে কেউ অটোগ্রাফ চাইলে সে একটু চমকেই ওঠে। ভারী সংকোচও বোধ করে। মার্ক স্পিৎজ হওয়ার জন্য তো আর সে সাঁতরায় না। জল তার পরম নীল নির্জন, জল তার এক আকাঙিক্ষত একাকিত্ব, জলে সে আত্মার মুখোমুখি হয়।