শেষ ব্যাচে খেয়ে গৌরকে বারকয়েক ট্রিপ দিতে হল আত্মীয়-স্বজনদের যে যার ডেরায় পৌছে দিতে। দু’ খিলি পান গ্লাভস চেম্বারে রেখে দিয়েছিল। শেষ ট্রিপটা মেরে ফেরার পথে লেকে জলের ধার ঘেঁষে গাড়ি দাড় করিয়ে পান মুখে দিয়ে সিগারেট ধরাল গৌর। জলে আলো ভাঙছে। নানারকম আলো। জোর বাতাসে জলের গন্ধ আসে। শব্দ আসে। ফুলের মালাগুলি বাতাসে শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শুকোবার আগে শেষ তীব্র সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাড়ির ভিতরে সেই গন্ধ ভার হয়ে থাকে গৌরের বুকে। এক-একটা ঝিমুনি চমকে আবার জেগে যায়।
কী বলেছিল মেয়েটা? কী যেন! আপনি আমার বিয়ের ভাংচি দিলে খুশি হতাম। আরে বাঃ! গৌর ঘুম-ঘুম চোখে ভাবে। কথা ক’টা নেশারু ওম এনে দেয় চারধারে। এমন স্বার্থহীন ভালবাসার কথা তাকে কেউ কখনও বলেনি। মেয়েটার যে বর জুটছিল না এমন নয়। চা আর কুঁচো নিমকি দিয়ে এক হাত বাই চল্লিশ হাত জমিও তারা পেয়ে গেছে। তবে আর ওই কথা বলার কী স্বার্থ ছিল তার? না কি ঠাট্টা করেছিল? তাও নয়, গৌর একা একা মাথা নাড়ে। কথাটা কুঁচো নিমকি আব চা-কে অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এক হাত বাই চল্লিশ হাত জমির স্বার্থত্যাগও তার কাছে লাগে না। বিয়ের চিত্রিত পিড়ির দিকে এক পা বাড়িয়েও কীরকম দীর্ঘশ্বাস তার! সে তো কখনও কিছু বলেনি গৌরকে আগে! বললেও লাভ ছিল না অবিশ্যি। হাফ-ফিনিশ গৌরের মূর্তিখানা পুবো গড়া হয়নি যে। তার অর্ধেক দুনিয়া ভূতের কজায়, বাকি অর্ধেক সে এক দুলদুলে মিহিন বোটায় দুলছে। কখন ছিড়ে পড়ে কে জানে! মেয়েটা সবই জানত। তবু এই কথাটা বলে চিরকালের মতো চলে গেল।
চলে গেল বলে অবশ্য গৌরের কোনও ক্ষতি নেই। মেয়েটার জন্য তার দুঃখ হয় না। বরং যতবার সেই কথাটা মনে হয় ততবার আনন্দে গৌরের গা কেমন করে। ওই কথাটুকুর মধ্যেই রয়ে গেল গৌরের মুখে চন্দনের ফোঁটা, গলায় মালা, মাথায় টোপর। গৌরের আর কী চাই! জীবনে। এরকম অনেক রহস্য থেকে যায়, যার সমাধান মানুষ চায় না। ওরকম ‘-একটা রহস্য থেকে যাক। বাংলাদেশে ঝড়তি-পড়তি মেয়ের অভাব নেই। গৌরের আছে চালু ল্যান্ডমাস্টার, সাড়ে চার কাঠা জমি, এখনও দু’খানা ভাল হাত-পা রয়েছে তার। এর জোরে গলা বাড়ালে কেউ কেউ এখনও মালা দেয়। কিন্তু অমন স্বার্থহীন কথা কেউ শোনাতে পারে না।
এক গভীর আত্মপ্রসাদে, আনন্দে তার মনের আনাচে-কানাচে আলো এসে পড়ে। বাতাস বয়। দুটো রুখে-শুখো হাত-পা, মাথায় নাচের শব্দ, হাফ-ফিনিশ গৌর তার ভুতুড়ে ল্যান্ডমাস্টারের সিটে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে লেকের বাতাসে কখন ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে নানারকম সুন্দর স্বপ্ন দেখে সে।
পরদিন আবার কলকাতার সোয়ারি এধার ওধার করতে বেরোয় গৌর।
.
কলকাতার সোয়ারিরা ট্যাক্সি-ট্যাক্সি’ বলে ডাকে। গৌরের গাড়ি থামে। মিটার ঘোরে। সোয়ারি খালাস হয় আবার। তখন গৌর মাঝে মাঝে আয়নাটা মেপেজুখে ঘুরিয়ে রাখে। পিছনের ফঁকা সিটখানা দেখা যায়। সেই সিটে মাঝে মাঝে নন্দীদের মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখে গৌর। তার কল্পনার মেয়েটা আরও সুন্দর হয়। ক্রমে ক্রমে আরও সুন্দর হয়ে উঠতে থাকে। চোখে চোখ পড়ে। কেউ চোখ সারায় না। গৌর বিড়বিড় করে বলে, আরও সুন্দর হও, আরও আরও সুন্দর। মেয়েটা সুন্দর হতে থাকে। তার বাদামি চামড়ায় দুর্লভ গোলাপি রং ফুটে ওঠে, চোখের তারা হয়ে যায় আকাশি নীল, চুলে ভোরের আলোর সোনালি আভা এসে লাগে, ঠোঁট তরমুজের মতো লাল। আবার তার চেহারা পাল্টে ফেলে গৌর। গায়ের চামড়া বাদামি, চুলে মধুর মতো রং, চোখ সমুদ্রের মতো সবুজ…
ডেডবটিটা মাঝে মাঝে মচ করে নড়ে ওঠে। গৌর ধমক দিয়ে বলে, চোপ! নো ইন্টারফিয়ারেন্স ইন লাভ…নো ইন্টারফিয়ারেন্স…বলতে বলতে গৌর হাসে। তার মনে হয়, লম্বা সুতো ছেড়ে যেমন উলের বল গড়িয়ে যায় তেমনই নন্দীদের মেয়েটার সেই কথাটা গড়িয়ে আসছে। আসছে তো আসছেই। যতদূর যাবে গৌরহরি, বগলুর ব্যাটা, ততদূর যাবে। সেই সুতোর একপ্রান্তে বসে মেয়েটা বুনে যাচ্ছে একখানা সোয়েটার। সেই সোয়েটারের ডিজাইনের পরতে পরতে গৌরহরির নাম লেখা হয়ে যাচ্ছে।
সোয়ারিরা মুখ বাড়ায় জানালায়।
কোথায় যাবেন? গৌরহরি জিজ্ঞেস করে।
সোয়ারিরা কত নাম বলে। টেরিটিবাজার, হাটখোলা, মুর্গিহাটা, হাওড়া। সেইসব নাম লোহার পাতের মতো গৌরের চারধারে একখানা শক্ত জাল বুনতে থাকে। ছেলেবেলায় সার্কাসে গৌর মৃত্যুকূপের যে খেলা দেখেছিল, তাতেও ছিল ওইরকম মজবুত একখানা জাল। ভিতরে দু’খানা। মোটরসাইকেল গোঁ গোঁ করে ঘুরত ফিরত, ল্যান্ডমাস্টার তেমনই কলকাতার চারধারে জালে আটকে ঘোরে ফেরে। বাইরে যায় না।
বিকেলের দিকে মৌতাত জমে ওঠে ঠিক। সেইসময়ে কলকাতার রাস্তাঘাট মুছে গিয়ে কে যেন খাল নদী নালা কেটে রেখে যায়। কোথা থেকে জলধারা এসে কুলকুল করে বইতে থাকে। স্টিমলঞ্চ যায় আসে। বয়ার ওপরে দাঁড়িয়ে টালমাটাল জল-পুলুস ট্রাফিক সামলায়। ঢাকার কামান দুর থেকে রঙিন গোলা ছুঁড়ে মারে। তখন ফাদার ফ্রান্সিস তার স্বপ্নশিশুদের নিয়ে মাটির কাছাকাছি চলে আসেন। গৌরহরির দিকে ছুঁড়ে দেন সেই বল, ফ্যাস…ফ্যাস দি বল, গৌর… গৌর হাত বাড়ায়। ধরতে পারে না। ফাদার হেসে কুটিপাটি হন। মাঝে মাঝে গাভীর ডাক শোনে সে। ট্রাফিক পুলিশ কৃষ্ণের মতো দাঁড়ায়, হাতে আড়বাঁশি, পা দুখানা ক্রশ করা। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে আটক গাড়িগুলো তখন গাভী হয়ে ডাকতে থাকে।