একটা ঘর ফাঁকা পড়ে থাকে। সেখানে পুরনো ব্যাটারি, পুরনো টায়ার, গাড়ি সারানোর কিছু যন্ত্রপাতি পড়ে থাকে। অন্য ঘরটায় একখানা তক্তপোশ, দুখানা সস্তা বেতের চেয়ার, দু’একটা ট্রাঙ্ক, বাক্স, একটা ফ্যান, দু-একটা থালাবাসন। ব্যস, আর কিছু নেই। ঘর দু’খানা ঘিরে কাঠা চারেক জমি। উত্তরদিকে খানিকটা নন্দীরা সীমানা-দেয়াল দেওয়ার সময়ে দখল করে নিয়েছে। রাখোহরি থাকলে পারত না। নন্দীবাড়ির মেয়েটা সকালে বা বিকেলের দিকে গৌর বাড়ি থাকলে এক-একদিন কুঁচো নিমকি দিয়ে চা দিয়ে গেছে। সঁটো শরীরের মেয়ে, দু’বার তাকাতে ইচ্ছে হয়। তার ওপর চা নিমকি! এসব গৌরের সামনে রেখে নন্দীরা তার নাকের ডগাতেই হাতখানেক ভিতরে দেয়ালের জন্য ধরল, গৌরকে ডেকে দেখাল, দেখ তো, ঠিক আছে? গৌর নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। দেয়াল উঠে গেল। গৌরের লজ্জায় কিছু বলা হল না। তা যাক গে এক হাত জমি। গিয়েও যা আছে তা গৌরের পক্ষে অনেক। সামনের দিকে শখ করে বাগান করেছিলেন বগলাপতি। এখন বাগান হেজে-মজে আগাছার জঙ্গল। একটু উঠোন মতো জায়গায় প্রকাণ্ড জামরুল গাছ ছায়া দেয়। মাঝে মাঝে গাছটা জামরুলে ছেয়ে যায়। গাছের গায়ে কাঠপিপড়ের বাসা। সেইসব পিঁপড়েদের তুচ্ছ করে কচিকটি জামরুল পাড়ে বাচ্চা ছেলেরা। ডাল ভাঙে, পাতা ছড়ায়। গৌর কিছু বলে না। বাগানের বেড়াটা ভেঙে গেছে কবে। গৌর সারায়নি। গোরু ঢুকে আগাছা খায় মটমট করে। পিছনের দিকে ঘর থেকে দুরে সেপটিক ট্যাঙ্কওলা পায়খানা আর বাথরুম, টিউবওয়েল ফিট করেছিলেন বগলাপতি। সে সবই রংচটা, পিছল, ভাঙা হয়ে পড়ে আছে। বাথরুমে যেতে বুক-সমান জঙ্গল। কচুপাতা, বিছুটি বন, ভাট আর ভাং গাছে ছেয়ে আছে। তার পিছনে বারোয়ারি পুকুর। অনেক রাতে পুকুরের জলে মাছ ঘাই দেয়, ব্যাং লাফিয়ে পড়ে। দেশ-গাঁয়ের শব্দের মতো সব শব্দ ওঠে। পুকুরের আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে। মশার ঝক পিন পিন করে। বাগানের একধারে গৌরের গ্যারেজ। সেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় ল্যান্ডমাস্টার। গৃহস্থ যেমন মাঝরাতে গোয়ালঘরে শব্দ পেলে কুপি জ্বালিয়ে দেখে আসে, ঠিক সেই রকম গ্যারেজে খুটখুট শব্দ পেলে গৌর টর্চ জ্বালিয়ে বেরোয়। ল্যান্ডমাস্টারখানা দেখে আসে। বগলাপতির দেওয়া সেকেন্ডহ্যান্ড ল্যাভুটা ছাড়া তার আর আছেটা কী?
ক’দিন পর পর বৃষ্টি গেছে খুব। কলকাতার রাস্তা-ঘাটে এখনও হাটুভর জল জমে আছে। গৌর তাই আজ সকালে গাড়ি বের করেনি। মেঘ কাটছে, রোদ উঠছে একটুখানি। উঠোনের মাঝখানে মাটি শুকিয়ে সাদা হচ্ছে ক্রমে। জামরুল গাছে এবার ফুল আসেনি। খুব পিপড়ে বাইছে। নন্দীদের পাঁচটা হাস পুকুর থেকে উঠে এসে গৌরের উঠোনে দাঁড়িয়ে রোদ পোয়ায়। এ ওর ঝুটি ধরে পিঠে চাপে। একটা মাদি হাঁস খেলতে খেলতে সামলাতে না পেরে তলতলে একটা ডিম পেড়ে ফেলে মাটিতে, একটা হাঁস সেটা কপকপ করে খেয়ে নেয়। জামরুল গাছের ছায়ায় একটা বেতের চেয়ার টেনে এনে বসেছে গৌর। কলকাতার একখানা স্ট্রিট ডাইরেক্টরিই গৌরের প্রিয় বই। অবসর পেলেই সেটা নিয়ে বসে। আজও বসেছে। কলকাতার সঙ্গে জানপয়ছান এখনও তার শেষ হয়নি। কবে হবে তা বলাও যায় না।
কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারে না সে। রাস্তার নাম মুখস্থ করতে করতে অন্য মনে চেয়ে থাকে। হাই তুলে বইখানা কোলে ফেলে রেখে তার বাড়িখানা দেখতে থাকে।
কতটুকুই বা জমি! কীই বা ভাল ঘরখানা। তবু বগলাপতির বড় সাধের বাড়িখানা। দেশের লোকদের সঙ্গে মিলেজুলে একদিন এইখানে থাকবেন, এরকম ইচ্ছে ছিল তার। ওদিকে বড়লোকদের পাড়ায় তিনতলাখানা ছাড়তেও কষ্ট হত তার। তাই এই বাড়িটা করে এক গরিব জ্ঞাতিকে বসিয়েছিলেন। কড়ার ছিল, যতদিন না বগলাপতির দরকার হয় ততদিন বিনা ভাড়ায় থাকবে। জ্ঞাতি কাকা হরিরাম সেই থেকে বসলেন বাড়িটায়। পুরুত মানুষ, খুব নিরীহ। তার পাঁচ ছেলেমেয়ে, বউ, বিধবা বোন নিয়ে বিরাট সংসার। কষ্টে চলত। বড় ছেলে নিতাই ছিল ব্যাঙ্কের পিয়োন। কী ভাগ্যে তার বউটা হল সুন্দরী। সেই বউই অবশেষে ভাগ্য ফিরিয়ে দিল তার। বিকেলের দিকে সাজগোজ করে বেরোত, একটু বেশি রাতে ফিরে আসত আবার। ঘরের বউয়ের মতোই চলাফেরা, শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে ঘোমটা, সব বজায় রেখে চলত সে। বিয়ের আগেকার এক হোকরা প্রেমিক ছিল তার। সে এখনও মুখের বড়শি ছাড়াতে পারেনি। চলে আসত রবিবারে রবিবারে। হাতে মাছ, মিষ্টি দইয়ের হাঁড়ি, বউটি তাকেও খুশি রাখত। চা খাওয়াত, ভাত খাওয়ার নেমন্তন্ন করত মাঝে মাঝে। সব বজায় রেখে বউটি নিতাইয়ের অবস্থা ফেরাতে লাগল আস্তে আস্তে। টেরিলিন-টেরিকটন পরতে লাগল নিতাই, সিগারেটের ব্র্যান্ড পালটে ফেলল। কিন্তু পাড়ায়। তখন তার বউয়ের নামে টিক্কিার। কত লোক যে তাকে দামি গাড়িতে চড়ে অচেনা পুরুষদের সঙ্গে যেতে দেখেছে, কত লোক লক্ষ করেছে রাতে ফেরার সময়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত তাকে গাড়ি এসে পৌঁছে দেয়। তখন নিতাইয়ের বউয়ের পা টলমল করে, খোঁপায় ফুল গোঁজা থাকে। নিতাই সেসব শুনে ভারী বিরক্ত হয়ে বলত, রিফিউজিদের সঙ্গে থাকা যায় না। পাড়ার উঠতি মেয়েরা পাছে ওই বউয়ের খপ্পরে পরে যায় সেই ভয়ে প্রতিবেশীরা মাঝে-মধ্যে চড়াও হলে নিতাই ঘর থেকে হেঁকে বলত, কেন তোমাকে সন্দেহ করে বলল তো! তুমি সত্যিই কিছু করো-টরো না তো? বউ কেঁদে বলত, ওমা! তাই কি পারিনিতাই বলত, আমার গা ছুঁয়ে বলল যে তুমি ওসব করো না! বউ তখন নিতাইয়ের গা ছুঁয়ে বলত যে সে ওসব করে না। তখন নিতাই বলত, তাহলে তোমার ভয় কী? সকলের মুখের ওপর বলে দাও সেই কথা। এ সব ঘটলে ক’দিন নিতাইয়ের বউ বেরোত না। তারপর আবার একদিন সাজগোজ করত, বেরোত, ফিরত রাত নিশুতির সময়ে। আবার তার বিয়ের আগের ছছাকরা প্রেমিক রোববার দই, মিষ্টি নিয়ে আসত। বগলাপতি কানাঘুষাে শুনে ডেকে পাঠালেন, এ সব কী শুনছি হরিরাম? হরিরাম ভারী তৃপ্তির হাসি হেসে বলতেন, ওরকম বউ হয় না। লক্ষ্মীমন্ত যাকে বলে। অবস্থার উন্নতি দেখলে কবে না পাঁচজন পাঁচ কথা বলেছে। ওই বউ আসার পর থেকেই আমাদের উন্নতি। বিষয়ি লোক বগলাপতি উন্নতির কথা শুনে খেকিয়ে উঠতেন, তোমার ছেলেরা কোন লাটসাহেবি পেয়েছে যে রাতারাতি উন্নতি হয়ে গেল? ওসব বোলো না। টাকাপয়সা কোন গলিখুঁজিতে ঘুরে বেড়ায় তা আমি জানি। আমার বাড়িতে থেকে ওসব চলবে না। হরিরাম ম্লান মুখে চলে গেলেন বটে কিন্তু তারপরই গোলমাল শুরু করে নিতাই আর হরিরামের আরও দুই ছেলে মাধু আর সতু। মাধু সতুর চেহারা বিশাল, স্কুলের এইট ক্লাসে আটকে পড়েছে, চুরি-চামারি দিয়ে বাল্যজীবন শুরু করে জোয়ান বয়সে বেশ ডাকাবুকো হয়ে উঠেছে। বাড়ির বউয়ের মান-ইজ্জত রক্ষার জন্য তারাও দাঁড়িয়ে গেল। তাদের সবচেয়ে বড় স্বার্থ ছিল অবশ্য এই সাড়ে কাঠা জমিওলা বাড়িটা। জমি বগলাপতির বাপের নয়, জবরদখল। যে দখল করে তার। দখলের অনেক পরে সরকার নামে নামে মঞ্জুর করেছে জমি। হরিরামের ছেলেরা বলে বেড়াতে লাগল, এই জমি বাড়িতে বগলাপতি কখনও থাকেননি, সুতরাং জমি তার নয়। জবরদখল জমিতে বসবাস না করলে স্বত্ব জন্মায় না। তারাই এতকাল যখন বসবাস করেছে তখন জমি তাদেরই। এইসব বলে তারা পাড়ার লোককেও ভজাতে লাগল। বগলাপতি জ্ঞাতিভাই হরিরামকে ঠিক তুলে দিতে চাননি। চাইলে তুলতে পারতেন। তার বদলে তিনি হরিরামকে অন্য জায়গায় জমি দেখে দিয়ে বললেন, বাড়িটা ছেড়ে দাও। হরিরাম ছাড়তে প্রস্তুত ছিলেন, ছেলেরা ছাড়ল না। মাধু আর সতু তখন পাড়ার মস্তান। নিতাইয়ের পকেটে বিস্তর নম্বরি নোট। তার আদুরি বউ বাড়িতে পাকা বাথরুম তুলে ট্যাপের জলে অনেকক্ষণ গন্ধ সাবান দিয়ে স্নান করে। কাউকে গ্রাহ্য করার নেই। পাড়ার ক্লাবে মোটা চাদা দেওয়া আছে। রাতে না ফিরলেও কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলে না। কয়েকটা নারকোল গাছ ছিল বাড়িতে, ফি বছর শ’খানেক নারকোল বগলাপতির বাড়িতে পৌঁছে দিত হরিরাম। গোটা কুড়ি সুপুরি গাছ থেকে প্রায় পনেরো বিশ সের সুপুরি আসত। হঠাৎ সেসব দেওয়া তারা বন্ধ করে দিল। বগলাপতির চাকর পৌষপার্বণের আগে নারকোল আনতে গিয়ে গলাধাকা খেয়ে ফিরে এল। হরিরাম এসে একদিন হাতে পৈতে জড়িয়ে কেঁদে পড়লেন, দাদা, আপনার জমিতে আমি পরগাছা। উঠতে চাই, কিন্তু ছেলেরা দিচ্ছে না। আপনি আমার দোষ নেবেন না। বগলাপতি শাস ফেললেন। মানুষটা বিষয় বটে কিন্তু হৃদয়হীন ছিলেন না। ভেবেচিন্তে বললেন, আমি যদিও রিফিউজি, কিন্তু জবরদখলের জমি আমার দরকার নেই। তুমিও অভাবী লোক, সময়মতো জমি নাওনি, এখন আর যাবে কোথায়? ওখানেই থেকে যাও। কিন্তু একটা শর্ত। আমার একটা ন্যাংলা-নুলো ছেলে আছে, গৌরা। ওর যদি কোনও চুলোয় যাওয়ার না থাকে তো তোমরা ওকে একখানা ঘর ছেড়ে দিয়ো। হরিরাম উত্তর দিলেন না। জামার হাতায় চোখ মুছে বললেন, দাদা, আমরা মা বাপ হয়েও ওই বাড়ির কোন কোণে পড়ে আছি, তো তোমার গৌরা। আমাদের দেশের বাড়িতে এ কোণে ও কোণে বেড়ালের মতো পড়ে থেকে কত জ্ঞাতি মানুষ হয়ে গেল, কত কর্মনাশা বুড়ো হয়ে দাবা তাস পাশা খেলে খেলে জীবনটা কাটিয়ে দিয়ে মরল, কেউ ফিরেও দেখেনি। কিন্তু আমার ছেলেরা তো একান্নবর্তী পরিবার দেখেনি। বড়বউমা যদি আজই বলে তার বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়িকে আলাদা করে দিতে তো নিতাই তাই দেবে। ওরা রক্তের সম্পর্ক চেনেই না। জ্ঞাতি তো দূরের কথা। কুকুর বেড়ালটা যে এঁটোকাটা খায় তাও ওদের গায়ে লাগে।