মেয়েটা চোখের বিদ্যুৎ পলকে তার পুরুষকে স্পর্শ করে বলে, আমি জানি, ও ভুল রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে।
নিক। কত নেবে? রাস্তা ঠিক পেয়ে যাব।
মেয়েটা দমে না। হাত বাড়িয়ে গৌরের শার্ট খামচে ধরে বলে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
গৌর বিনীত স্বরে বলে, পেছন থেকে ছোরা বসিয়ে দাও না। কিংবা মারো লাঠি। পুলিশও ডাকতে পারো।
মেয়েটা জামা ছেড়ে দিয়ে হাসতে থাকে। আয়নায় গৌর দেখে, কী সুন্দর সাদা দাঁত! এমন ঝকঝকে সরল পঁাত সে কারও দেখেনি।
দেহাতি লোকটা দার্শনিক। ঠিক জানে তাদের বেশিদূরে নিয়ে যেতে পারবে না। কলকাতার ঘুণচরে ঘুরে খানিক মিটার ওঠাবে মাত্র। দেহাতি বোকাসোকা লোক, ঝগড়া করে পারবে না। মিটার যা ওঠে তা দিয়ে দেবে। রুখখা-শুখো হাত-পা-ওলা আর মাথায় এক বেহদ্দ মাগির পাগলা নাচ নিয়ে গৌর কোনও শালার কিছুই আর কেড়ে নিতে পারে না। এইসব ভাবে গৌর আর গাড়িটাকে বেমক্কা ঘোরায়। যে রাস্তায় যায়, ঘুরেফিরে আবার সেই রাস্তায় আসে। কী যে সঠিক সে চায় তা বুঝতে পারে না।
আরে বাঃ! এতক্ষণ মেয়েটা আয়নাটা লক্ষ করেনি। এখন করেছে। গৌর চোখ তুলেই মেয়েটার চোখ দেখতে পায় একপলক। মেয়েটা স্থিরদৃষ্টিতে আয়নার দিকে চেয়ে আছে। চোখে প্রথমে ভয়, তারপর কৌতূহল দেখা দেয়। গৌর চেয়ে থাকে। ল্যান্ডমাস্টার টাল খায়। কিন্তু বহুকালের পোষা গাড়ি বলে বে-জায়গায় টক্কর খায় না। গৌর সামলে নেয়। আবার আয়নায় চোখ চলে যায়। মেয়েটা চেয়ে আছে। চোখ পড়তেই রহস্যময় হাসে। ঘোমটা তুলে আধখানা মুখ ঢাকে মেয়েটা, ঢাকে সেই দিকটা যে দিকে তার শাশুড়ি আর স্বামী রয়েছে। তারপর হঠাৎ চোখ ছোট করে জিব বের করে গৌরকে ভেঙিয়ে দেয়। আরে বাঃ! খুব শিখেছে তো!
লোকটা গৌরের যথেচ্ছাচারে বাধা দেয় না। কেবল একবার বিরক্ত হয়ে ভিতু গলায় বলে, একটু আস্তে চলো না ভাই। আমার বুড়ি মার শরীর ভাল না, জোরে চললে বুড়িমার কষ্ট হবে।
গৌর একটু স্পিড কমায়, আবার বাড়ায়। ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে। ঘাড়ের যে জায়গাটায় মেয়েটা শার্টের কলার চেপে ধরেছিল সে জায়গাটা একটু শিরশির করে। ল্যান্ডমাস্টারটা জলের মতো বয়ে যায়। তাতে অনেক মুখের ছায়া পড়ে, আঙুলে কেউ বা জলে ছবি এঁকে যায়। কিছুই থাকে না। ক্ষণস্থায়ি একটি দেহাতি মেয়ের মুখ গৌর তার আয়নায় কতক্ষণ বা ধরে রাখতে পারে!
ল্যান্ডমাস্টার গাঁই গাঁই করে ঘোরে। জলের মতো বয়ে যায়। মেয়েটা যে কোণে বসে আছে, সেই কোণে একটু হেলে আধবোজা চোখে বসে ছিল মতিয়া। বহুদিন হয়ে গেল, তবু গৌরের হুবহু মনে আছে, দুর্লভ আতরের গন্ধে ভরে গিয়েছিল ল্যান্ডমাস্টার, সবুজ কাচের মতো স্বচ্ছ ওড়নার সোনালি চুমকির পিছনে তার মুখ। চমকে চুমকি জ্বলে জ্বলে উঠেছিল বার বার। ওড়না উড়ছিল হাওয়ায়। সিল্কের লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ পরে লাল রঙের সুন্দর মতিয়া আধশোয়া হয়ে পড়েছিল। সেইদিনই ল্যান্ডমাস্টারের দশ পারসেন্ট আয়ু বেড়ে যায়।
কিন্তু কিছুই থাকে না। সেই আতরের সুগন্ধ লোকের গায়ে লেগে লেগে মুছে গেছে। ঘাসপাতার সুবাস-ওলা এই মেয়েটির সতেজ শরীর, একটু ঘামে-ভেজা গায়ের বোঁটকা গন্ধ ল্যান্ডমাস্টারের গদির গায়ে কতক্ষণ লেগে থাকবে! ট্যাক্সি আসলে এক বহমান নদী। স্রোতে ছায়া পড়ে, ভেঙে যায়।
গৌর শ্বাস ফেলে গাড়ি আনে সহজ রাস্তায়। পার্ক সার্কাসের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, মিটারে দেড় টাকার মতো বেশি উঠে গেছে, মৌতাতের সময়টা এগিয়ে আসছে ক্রমে।
চোখে ঘুমের আঁষ জড়িয়ে আসে। কোন শূন্য থেকে লাল নীল হলুদ বল নেমে আসে পৃথিবীতে। চরাচর জুড়ে রঙিন বলগুলো ওড়ে কেবল। ঢাকার কামান নিঃশব্দে গোলা ছেড়েন্যে। মুহুর্মুহু দাগতে থাকে গোলা। গৌরের আয়নায় মেয়েটা ঘোমটায় আধোঢ়কা মুখে আবার জিব ভেঙায়। তার খাঁদা নাকের নীচে ফোটা ফোটা ঘাম জমছে। দেহাতি শরীরের কাচা গন্ধ, তার সঙ্গে রোদ-মাটির সুবাস, গাছপালার ক্লোরোফিল সব ল্যান্ডমাস্টারের ভিতরকার চৌকানা বাতাসকে টইটম্বুর করে দেয়। গৌর খাস টানে। তবু সোয়ারি খালাস দিতে হবে বগলুর তিন নম্বরকে। তারপর দাশ কেবিন। গৌরের সঙ্গে দু’খানা রুখে-শুখো হাত পায়ের মতোই সেঁটে গেছে ল্যান্ডমাস্টার। সেঁটে গেছে দাশ কেবিন। সেঁটে গেছে কলকাতার রাস্তাঘাট। মিউনিসিপ্যালিটির ম্যাপ। মিটারের পরিবর্তনশীল সংখ্যা আর মিটার ঘোরানোর টুংটাং। মৌতাতের সময়ে ঢাকার কামান কোন দূর থেকে ঠিক রঙিন বল ছুঁড়ে মারে আকাশে। রাস্তার ওপর দিকে উঠে যায়। কলকাতার মাঝখানে কারা যেন জলময় শহর বানিয়ে রেখে যায়। গাভীর ডাক শোনে গৌর। মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ হঠাৎ ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে কদমতলার বাঁশের বাঁশিটি আড় করে ধরে পা দুটো ক্রশ করে কৃষ্ণের কায়দায় দাঁড়ায়। এ সব জিনিসই সেঁটে গেছে গৌরের সঙ্গে। এর কোনও পরিবর্তন নেই।
গৌর শেকসপিয়ার সরণি পেয়ে যায়। লোকজন ভুসভাস উড়ে যাচ্ছে। ফঁকা রাস্তায় গাড়ি জোরে ছাড়ে গৌর। পিছনে বুড়িটা ককিয়ে ওঠে। অস্ফুট ভয়ের শব্দ করে পুরুষটা। মেয়েটা মুখ ভেঙাতে গিয়ে হঠাৎ টের পায় বাতাসে ঘোমটা উড়ে গেছে, স্বামী চেয়ে আছে তার দিকে। লজ্জায় জিব কাটে সে। বাতাস তার বেণীতে বাঁধা চুল লুট করে এনে কপালে ঝাপটা মারে। গৌরের গাড়ি গতির যন্ত্রণায় গোঙায়। টায়ার রাস্তায় গভীর বসে যায় লাঙলের মতো। গাড়ির জোর টানে ল্যান্ডমাস্টারের গভীর গদির মধ্যে দেহাতিরা সেঁধিয়ে যেতে থাকে, ড়ুবে যেতে থাকে।