উঠতে দিচ্ছে না যে! যা ভিড়। বাবা গো, নিয়ে চল।
গাড্ডা। গৌর শ্বাস ফেলে দরজা খুলে দেয়। তিনজন ভারী খুশি হয়ে গাড়িতে ওঠে। গাড়ি ছাড়তে বুড়ি হাত বাড়িয়ে শালপাতার ঠোঙায় সিদুরমাখা পাঁড়া প্রসাদ দিয়েছে, জবাফুল, আর একটা কমলালেবু। সেসব এখনও গৌরের সিটে পড়ে রয়েছে। কাটোয়ার গাড়ি পেয়ে গেছে ওরা।
বেলাইনে গাড়ি ঢোকায় গৌর। একটা টাকার মামলা। বেরিয়ে এসে আড়মোড়া ভেঙে স্টেশনের ঘড়িটা দেখে। ফরসা চাদরের মতো ধবধবে রোদ পড়ে আছে। ঘড়িতে মোটে একটা। বেলাইনে আরও কয়েকটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে একটা গৌরের চেনা। গৌর একটু এগোতেই মলিনকে দেখতে পায়। সিটে দুই পা তোলা, ঠোঁটে ভেজা সিগারেট, হাতে বই, মলিন বসে আছে। কোনওদিকে খেয়াল নেই।
গৌর বলে, মামু!
মলিন মুখ তুলে হাসে, কী বে ত্রিভঙ্গমুরারী, কী খবর?
খবর নেই। তোমার খবর বলো।
মলিন উদাস গলায় বলে, তোমার সাউথে গ্যারেজ, আরামে আছে।
আরাম কীসের?
মলিন হাসে, বেশ্যা আর ব্যাপারিদের গা আর বগলের গন্ধ শুকতে হয় না আমার মতো। এই মাত্তর একবোঝা বিড়ির পাতা খালাস দিলাম। তোমার গাড়িতে যারা ওঠে তারা আতরের গন্ধ রেখে যায়।
গৌর হাসে, এখনও সোনাগাছিতে কমলার বাবু ধরে দিচ্ছ নাকি?
মলিন উদাস গলায় বলে, দিই। গাড়ির যেমন সোয়ারি দরকার তেমনি ওদেরও। নর্থের গলিখুঁজিতে ঘুরলে না তো, তাই তোমার চুল পাকেনি। তা সাউথে বৃষ্টিবাদলা কেমন? আর মেয়েমানুষ?
গৌর বলে, কী যে বলো!
মলিনের মুখের আটক কোনওকালে নেই। ওর ট্যাক্সিখানা গৌরের মতো হরবখত যেমন-তেমন পাবলিককে তোলে না। বেছে বেছে তোলে। দু’হাতে পুলিশকে পয়সা দেয় মলিন, আবার দু’হাতে ললাটে। বলতে গেলে, সারা দিনমান গাড়িখানা গ্যারেজেই থাকে, বেরোয় বিকেলের পর। জায়গা বেছে পঁাড়ায় বড় হোটেলের তলায়, মাতালদের পৌঁছে দেয়। শনিবারে বাঁধা রেসের ময়দান। সেখানে শেয়ারের পান্টদের তোলে। মাসে তিরিশদিন পুলিস তার লাইসেন্স কেড়ে নেয়। তিরিশদিন ফেরত দেয়। হাড়কাটার মতিয়া কখনও কখনও মলিনের গাড়িখানা ভাড়া নেয় সারা বিকেলের জন্য। ময়দানের কাছাকাছি নির্জনে গাড়ি দাড় করিয়ে মলিন নেমে গিয়ে ঘাসে শুয়ে থাকে। মলিনের গাড়ি তখন মতিয়ার ঘর হয়ে যায়। বাবু আর মতিয়া থাকে কেবল। আর থাকে। গঙ্গার হাওয়া। থাকে জ্বালা-যন্ত্রণা। টাকা ওড়ে।
মতিয়া বড় সুন্দর। এত সুন্দর গৌর কদাচিৎ দেখেছে। থােপা থােপা লালচে চুল, নরম মুখ, রোগাটে শরীর, আর কী গম্ভীর চোখ। তাকে একবার পৌছে দিয়েছিল গৌর। সেদিন মলিনের গাড়ি ছিল খারাপ। গৌরের বুক খুব কেঁপেছিল। মতিয়া কিন্তু একবারও দেখেনি কে গাড়ি চালাচ্ছে। একটা রুখখা-শুখো হাত-পাওয়ালা দুঃখী লোক গৌর, গৌরা, বগলুর ছাওয়াল, সময়মতো পোলিও আর টাইফয়েড না ধরলে যে বিলেত চলে যেত, হয়তো বিয়ে করত মেম। এতদিনে কত কী হয়ে যেত গৌর! মতিয়া সেই গৌরকে দেখেইনি। ট্যাক্সিওয়ালা ভেবে ভ্রুক্ষেপ না করে নেমে গেল হাড়কাটা গলির ভিতরে এক বাড়ির সামনে। চাকর এসে টাকা দিয়ে গেল। মতিয়ার সঙ্গে পাবলিকের কারবার নেই, গৌর জানে। মতিয়া দরজায় দাঁড়ায় না, ডাকে না, ইশারা করে না। তার ঘরে টেলিফোন আছে, সাদা শিশুকাঠের খাট আছে, ড্রেসিং টেবিল আছে, রেফ্রিজারেটারও। যেমন বাছাই তার জিনিসপত্র, তেমনই বাছাই তার পুরুষেরা। আজও গৌরের গাড়ির গদি শুকলে বোধহয় মাতিয়ার সেই দুর্লভ গন্ধটুকু পাওয়া যাবে।
মতিয়ার কথা ভাবতে গিয়ে একটু অন্যমনস্কতা এসে গিয়েছিল গৌরের। মলিন ডেকে বলে, তোমার ফাতনা নড়ছে গৌর, দেখো।
একটা লম্বা লোক কোলে একটা ফ্যাফ্যাতে বাচ্চা, সঙ্গে ফরসা বউ। তারা গৌরের গাড়ির হাতলে লক করা বলে দরজা খুলতে পারেনি, নইলে উঠে বসত। ভুখখা পার্টি, বালী কি রিষড়ে থেকে এসেছে। সিনেমায় যাবে হয়তো, কিংবা যাদবপুর কি বেহালার আত্মীয়বাড়ি। মাসে এক-দুই দিন বউ নিয়ে বেরোয়, তখন ট্যাক্সি চড়ে।
গৌর এগোয় না। দূর থেকেই হেঁকে বলে, গাড়ি যাবে না দাদা।
লোকটা একভিড় মানুষের মধ্যে ট্যাক্সিওয়ালাকেই খুঁজছিল। এখন গৌরকে দেখে মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, কেন?
গাড়ি খারাপ আছে। ইঞ্জিন গরম।
লোকটা কপালের ঘাম হাত দিয়ে কঁচিয়ে ফেলে। বউটার মুখের পাউডার ঘামে গলে যাচ্ছে।
লোকটা একবার মুখ তুলে স্টেশনের ঘড়িটা দেখে গৌরকে ধমকাবে না কাকুতি মিনতি করবে তা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বলে, বড় বিপদ ভাই। সোয়া একটা বেজে গেছে, দুটোয় পৌঁছতেই হবে।
লাইনে দাঁড়িয়ে যান না, পেয়ে যাবেন।
লোকটা শুকননা গলায় বলে, লাইনে দাঁড়ালে পঁচিশজনের পিছনে পড়ে যাব। অন্তত আধঘণ্টা। বড্ড বিপদ।
বিপদ! কার না বিপদ! কলকাতা-সুন্ধু মানুষ রাস্তায় দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে সারা দিনমান ‘বিপদ, বিপদ’বলে চেঁচাচ্ছে। গৌরের গাড়ি কি দমকল না অ্যাম্বুলেন্স? তবু তো গৌর দাঁড়ায়, মলিন হলে? যেদিন, যেখানে তার গাড়ি যাচ্ছে, একমাত্র সেদিকের বা সেখানের সোয়ারি ছাড়া তুলবেই না। পুলিশ ডাকো, তম্বি করো, মলিন উত্তর দেবে না। পুলিশ লাইসেন্স কেড়ে নিলে শান্তভাবে দিয়ে দেবে। জানে, লাইসেন্স তার পোষ পাখির মতো। লোক-দেখানোর জন্য উড়ে যায়, আবার চোরাপথে ফিরে আসে। কার কী বিপদ তা নিয়ে মলিন মাথা ঘামায় না, রেসের বইটি খুলে ক্লাসে ফাস্ট-হওয়া ছাত্রের মতো মনোেযোগ দিয়ে বইখানায় ড়ুবে যাবে। আর তখন ভুখখা পাটিদের পিজরাপোলে বৃথা টক্কর মেরে গৌরের ল্যান্ডমাস্টারের আয়ুক্ষয় হয়। মতিয়ার গায়ের গন্ধটুকু লোকের গায়ের ঘষায় ঘষায় উঠে যাচ্ছে ক্রমে।