জাহাজিটা হেঁচকি তোলে।
পিছনের জানালা গলে তিনটে পরি ঢোকে। গৌর আড়চোখে আয়নায় দেখে নেয়। ন্যাংটাপুটো, সাদা। মোটা মোেটা থােরা, নধর হাত, নাদা পেট। সোনালি ডানাগুলো পাতলা ফিনফিনে, যেন বা মাকড়সার জালে তৈরি পাখাগুলো থিরথির করে কাঁপে।
ই-ফ!— জাহাজি আবার হেঁচকি গেলে।
চোপ!–ধমক মারে গৌর, হেঁচকি তুলো না। পরিরা ভয় পাবে।
জাহাজি অবাক হয়ে বলে, কারা বললে?
পরিরা।
কোথায়?
পিছনের সিটে বসে আছে। তিনজন। এখন হেঁচকি তুলো না।
জাহাজি মুখ ফিরিয়ে দেখে। তারপর বলে, কোথায় কী?
আছে। তাকিয়ো না।
জাহাজি গম্ভীর হয়ে বলে, আসলে কলকাতার শুড়িরা
বলে ঠোঁট চাটে জাহাজি। গৌর গাড়িখানা কঁকা রাস্তায় ঘোরাতে থাকে। ড্যাশবোর্ডে তেলের কাটা নেমে যাচ্ছে। গৌর তা লক্ষ্য করে না। সে কেবল চরাচর জুড়ে পরিদের কাণ্ড দেখে।
জাহাজিটা বলে, আমরা জানালায় বসে সেই নিয়োন সাইনটা দেখতাম।
কোন নিয়োন সাইন?
সেই যে, তুমি চাও লায়লার রুটি। সবুজ রঙের নিয়োন সাইন। ঘরটা সবুজ আলোয় চমকাত। আমি স্যুকে জিজ্ঞেস করতাম, স্যু, লায়লা কে? ও আমাকে জিজ্ঞেস করত, লায়লা কে? আমরা কেউ বলতে পারতাম না। অথচ নিয়োন সাইনটা সন্ধে রাত্রি থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সবুজ আলো দিয়ে একই কথা বলত, তুমি চাও…তুমি চাও..তুমি চাও…লায়লার রুটি। আমি সুকে জিজ্ঞেস করতাম, স্য, তুমি লায়লার টানে বাত, চাই। ফের সে আমাকেও ওই কথা জিজ্ঞেসকরত, আমিও চাই কি না, আমি বলতাম, চাই। কিন্তু মেট, খুঁজে দেখেছি, সেই রুটি পাওয়া যায় না।
পাওয়া যায় না?
না।
সে কী! তাহলে নিয়োন সাইনটা ছিল কী করতে?
জাহাজিটা একটু ভেবে বলে, অবিশ্যি দিনের বেলা তো কখনও লায়লার রুটির খোঁজ করিনি। দিনের বেলা মনেই থাকত না। রাত্রি বেশি হলে যখন নিয়োন সাইনটা নজরে পড়ত, তখন আমরা খুঁজতে বেরোতাম। পাওয়া যেত না। মেট, সেই থেকে লায়লার রুটির জন্য আমি অস্থির হয়ে আছি। এখনও মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুমে আমি স্বপ্ন দেখি, নিয়োন সাইন জ্বলে জ্বলে উঠছে, তুমি চাও…তুমি চাও…তুমি চাও…ভয় পেয়ে উঠে বসি, আর তখন বাদবাকিটা মনে পড়ে, লায়লার রুটি…লায়লার রুটি…লায়লার রুটি…
মাতাল। গৌর হাসে।
জাহাজিটা ঠোঁট চাটে। একটা রথম্যান ধরাবার চেষ্টা করে। দেশলাই জ্বালতেই গৌর ধমকায়, আলো জ্বেলো না।
কেন?
পরিরা পালাবে।
আঃ! জাহাজি হতাশভাবে সিগারেট ফেলে দেয়। তারপর বলে, লায়লার রুটি। সবুজ আলো, স্যু, জ্যোৎস্না—মেট, এসব কোথায় গেল? কলকাতা একদম শুকিয়ে গেছে যে। কিছু নেই।
গাড়িটা আপনা থেকেই ঘুরেফিরে চলে যাচ্ছিল। গৌর দিক ঠিক করতে পারে না। আসলে গাড়ি যখন মাটির ওপর দিয়ে যায় তখন রাস্তাঘাট ঠিকই চিনতে পারে গৌর, গৌরা, বগলাপতির ব্যাটা। তখন তার সব ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে। কিন্তু এখন, এই পরিদের রাজ্যে চলে এলে, মাঝরাতে দিক নির্ণয় করা ভারী মুশকিল। গাড়ি তখন নিজের থেকেই চলে। গৌর কেবল নিমিত্তমাত্র।
চাঁদ ঢলে পড়েছে। আকাশের একদিকটা কালিবর্ণ, বেশ্যার চোখের কাজলের মতো, সেই কালিবর্ণে ফ্যাকাসে শসার মতো চাঁদ ঢলে পড়ে যাচ্ছে। গৌর এই মর্মান্তিক দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
জাহাজি হঠাৎ আঁতকে উঠে বলে, এটা কোন জায়গা! অ্যাঁ! কোন জায়গা? থামো মেট।
গৌর থামে।
একটা পুরনো প্রকাণ্ড বাড়ি বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে। অন্ধকার। রাস্তাটা নিঝঝুম। চারদিকে সুনসান নির্জনতা। রাস্তায় সারি সারি গাছ। গাছের আড়ালে আড়ালে রাস্তায় টিমটিমে আলো। হাওয়ায় গাছের পাতা নড়লে আলোগুলো দোল খেয়ে যেতে থাকে। গৌর রাস্তাটা ঠিকঠাক চিনতে পারে না। গভীর গলায় বলে, কী জানি!
জাহাজিটা মুখ তুলে বাড়িটা দেখে।
মেট!
উম।
এই বাড়িটা আমার চেনা।
গৌরও বাড়িটা দেখে। কলকাতার প্রথম বয়সে তৈরি বাড়ি। পলেস্তারা খসে পড়ছে। বোধহয় কর্পোরেশনের নোটিশ পেয়েছে। ভেঙে ফেলা হবে। তাই সবাই ছেড়ে গেছে বাড়ি। একা অন্ধকার বাড়িটা আয়ুর শেষে ক’টা দিন নির্জনে ঝিমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে।
গৌর হাই তোলে।
জাহাজি হঠাৎ গৌরের হাত চেপে ধরে বলে, বাড়িটা আমি চিনি মেট। এখানে আমি এসেছি।
কার কাছে?
জাহাজি ফিসফিস করে বলে, স্যুর কাছে।
গৌর চমকে বলে, এই বাড়িটাই?
তারা নামে। আগে জাহাজি, পিছনে গৌর।
বাড়ির দরজাটা হাঁ হাঁ করছে খোলা। একটা পাল্লা বাতাসে নড়ে চামচিকের মতো শব্দ করছে। আরশোলার নাদির গন্ধ পাওয়া যায়। আর বহু পুরনো এক বদ্ধ বাতাসের ঘ্রাণ।
জাহাজি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে একটু তাকিয়ে থাকে। তারপর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, এইটাই। সেটারও দরজা এরকম চামচিকের মতো শব্দ করত।
জাহাজি শ্বাস ছাড়ে। বলে, মেট, চলল। দেখা যাক।
দু’জনে সিড়ি ভাঙতে থাকে। সিড়ি যতই ওপরে উঠেছে ততই আরও অন্ধকার, পিছল পিছল, ধাপ তত উঁচু উঁচু। ক্রমান্বয়ে চুনবালি খসে পড়ার একটা ঝিরঝির ঝুরঝুর শব্দ হতে কে। মুখে গায়ে ঝাপটা মেরে উড়ে যায় চামচিকে। টিকটিকি ডাকে।
ক’তলায়?–গৌর জিজ্ঞেস করে।
দশ তলায়। আমার মনে আছে।
গৌর অবাক হয়ে বলে, কিন্তু এ বাড়িটা তো মোটে চার-পাঁচ তলা।
ঠিক বলছ?
ঠিক। এ কলকাতার পুরনো বাড়ি, চুন-সুরকির গাঁথুনি, এর ওপর দশ তলা হয় না।
তাহলে! বলে জাহাজিটা নাক চুলকোতে চুলকোতে ভাবে। বলে, তাহলে ক’তলায়! ঠিক মনে পড়ছে না তো!