ময়নাকে অবশ্য তখন চেনার উপায় নেই। নেপালি পপাশাক ছেড়ে সে তখন চমৎকার সব ছাপা শাড়ি পরে। সাবান দিয়ে স্নানের পর গা ঝকঝকে পরিষ্কার। সিথেয় সিদুর, এক বেণিতে বাঁধা চুল, খুশিতে ফেটে পড়ছে। হরেন বোস দেখে খুশি হলেন। বললেন, ভয় নেই, ওর পরিবার থেকে ঝামেলা হবে না, তবে কাজটা পাকা করলেই পারতে।
দিগিন বত্রিশ বছরে মাথা তখন কম পাকাননি। বলেন, তা হয় না। আপনার মতো বাঁধা পড়ে যেতে আমি রাজি নই।
কিন্তু বদনাম? সিকিউরিটি?
ও সব ছাড়ুন! ওর পরিবারকে আমি হাজার টাকা দিচ্ছি কন্যাপণ হিসেবে।
ময়না এ রকম সম্পর্ক মানবে?
মানবে আবার কী? মেনে তো নিয়েছে।
না, মানেনি। বয়স কম বলে বুঝতে পারছে না যে তুমি ওকে রেখেছ মাত্র, বিয়ে করেনি। বয়স হলে বুঝবে।
ও এক রকম বিয়েই, কালীবাড়িতে নিয়ে গিয়ে মায়ের পায়ের সিদুর ছুঁইয়ে দিয়েছি!
বিচক্ষণ হরেন বোস গম্ভীরভাবে বললেন, ঠিক আছে। বিয়ে তো আসলে পরস্পরকে স্বামী বা স্ত্রী বলে স্বীকার করা। ও হলেই হল। টাকাটা দিয়ে এসো।
দিয়ে দিচ্ছি।
বলে দিগিন নগদ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন।
হরেন বোস মুখটা গম্ভীর করে রাখলেও মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন দিগিনের বিচক্ষণতায়, অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে দিগিনের সিকিমি ‘রাম’-এর বোতল খালি করলেন। বললেন, তা হলে টাইগার হিল থেকেই তোমার অধঃপতন শুরু হল?
দিগিন হাসলেন, উত্তর দিলেন না।
হরেন বোস বললেন, হঠাৎ এ রকম ধারা করতে গেলে কেন?
দিগিন একটু ভেবে বলেন, আসলে কী জানেন দাদা, যখন টাইগার হিলে উঠছিলাম তখনও ঠিক করিনি যে, মেয়েটাকে নিয়ে পালাব। ভেবেছিলাম আমার বাউন্ডুলে জীবন, দায়দায়িত্ব নেই, মেয়েটাকে পাকাপাকি বিয়েই করে ফেলি। কিন্তু টাইগার হিলেই গোলমালটা হয়ে গেল, একদম শেষ চড়াইটা বেয়ে যখন পাহাড়ের ছাদে চড়েছি, তখন দেখি সামনে অন্ধকারের এক মহাসমুদ্র। নীচে গভীর উপত্যকায় যেন কত হাজার বছরের অন্ধকার জমেছে। বাঁ দিকে উত্তরে ব্রোঞ্জের মতো কাঞ্চনজঙ্ঘার আবছা চেহারা, পাশে পাশে সব ব্রোঞ্জের পাহাড়। এ তো কত বার দেখেছি, নতুন কিছু নয়। সূর্য উঠবার আগেই প্রথম সূর্যের আলো এভারেস্টের ডগা ছুঁতেই যেন আগুন জ্বলে গেল বরফে, আশপাশে আবছায়ায় বিস্তর লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। ওই রকম ভোলা জায়গায়, ওই গভীর বিশাল অন্ধকারের সমুদ্র আর পাহাড়-টাহাড় দেখে মনে হল, জগতে বাঁধা পড়ার মতো বোকামি আর নেই। যার একটা শেকড় গজায় সে বাকি দুনিয়া থেকে উৎখাত হয়ে যায়। টাইগার হিলে সানরাইজ দেখতে দেখতেই ঠিক করলাম যে হাওয়া বাতাসের মতো একটা সম্পর্ক থাকাই ভাল।
হরেন বোস মাথা নেড়ে বললেন, বুঝেছি।
তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ নেশা করে বললেন, আমি তোমার চেয়ে অনেক বোকা।
দিগিন উত্তর দিলেন না।
হরেন বোস ময়নার ভেজে আনা ফুলুরিতে কামড় বসিয়ে বললেন, তুমি সুখী হবে।
ময়না ঘরে আসতে জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগছে রে? রামরও?
ময়না লজ্জার হাসি হাসে। মাথা নামায়।
হরেন বোস সস্নেহে একটু চেয়ে থেকে বলেন, মেয়েটা ভাল, দেখো দিগিন।
চিন্তা করবেন না, সব ঠিক আছে।
কিন্তু তবু সব ঠিক থাকেনি।
বছর দুই বাদে সমস্যা দেখা দিতে থাকে। বুদ্ধিমান দিগিন তার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন না। তবে দু-চারখানা চিঠিপত্র বছরে দিতে হত, দায়ে দফায় টাকা-পয়সা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ময়নার খবর তিনি কখনও দেননি। তখন প্রাচীনপন্থী মা বাপ বেঁচে, পুরনো প্রথাও মরে যায়নি পরিবারে। ভেবেছিলেন ব্যাপারটা চেপে রাখতে পারবেন।
কিন্তু দেশভাগের পর পরই চিঠি এল, বাড়ির সবাই চলে আসছে। তাদের থাকার বন্দোবস্ত যেন করা হয়। দিগিন মুশকিলে পড়লেন। ময়না খুব বোকা ছিল না, দু’বছরে তার বয়স আর অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। দিগিনের সঙ্গে তার সম্পর্কটাও ছিল অদ্ভুত। দিগিন ময়নাকে বিয়ে করা বউ বলে কখনও মনে করেননি। তাই মনে মনে নিজেকে ব্যাচেলার ভেবে যেমন খুশি নিজস্ব জীবনযাপন করতেন। পাহাড়ে ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন ব্যাবসার ধান্দায়। ঘরে একটা মেয়েছেলে আছে, সে ঝি বা রক্ষিতা, এর বেশি কিছু ভাবতেন না, ময়না সেটা বুঝতে পারত। উপায় নেই বলে মেনে নিত দিগিনকে। ঝগড়াঝাটি কিছু করত না তা নয়, তবে করেও লাভ ছিল না।
বাড়ির লোক আসছে, বহুকাল বাদে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। মা বাপ তখনও বেঁচে আছেন। দিগিন তাই গুরুং বস্তিতে ময়নার জন্য ভাল ঘর ভাড়া করলেন। খুব বেশি বোঝাতে হল না ময়নাকে। দু’-এক কথাতে সে রাজি হয়ে গেল। ময়নাকে গুরুংদের বস্তিতে পাঠিয়ে ঘরদোর সাফ করলেন দিগিন। তার কিছু মনে হল না। কোনও অভাব টের পেলেন না।
অবশ্য সম্পর্কটা ছিড়ে ফেললেন না। বাড়ির লোকজনকে এড়িয়ে রোজই যেতেন ময়নার কাছে। মাসোহারা তো দিতেনই, সব খরচ বহন করতেন ময়নার। ময়নাও অখুশি ছিল না। বাড়ির লোক ব্যাপারটা টের পেলেও কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। বয়সের ছেলের রোজগার যদি ভাল হয় তো তার দু-একটা স্বভাবদোষ মানতে কারও আপত্তি হয় না। ছেলে হল সোনার আংটি, বাঁকা হলেও দাম কমে না।
সেই ময়না এখনও দিগিনেরই আছে, তবে পুরোটা নয়। দিগিনের আটান্ন হলে ময়নার না হোক বিয়াল্লিশ বছর বয়স তো হলই। গুরুং বস্তি ছেড়ে বর্ধমান রোডে ঘোট একটা বাড়িতে উঠে গেছে। ময়না। বাড়ি করে দিয়েছেন নিজেই। ময়না যৌবনকালটা বড় চঞ্চলতা করেছে। গুরুং বস্তিতে উঠে যাওয়ার পর থেকেই সে দিগিনকে পছন্দ করতে পারত না। বার দুই পালিয়ে গেছে একটা অপদার্থ জাত-ভাইয়ের সঙ্গে। পোযায়নি বলে ফিরে এসেছে। লটঘট করেছিল নির্মল সিঙের ছোটছেলে অবতার সিঙের সঙ্গে। দিগিন শাসন করেছেন, বিয়ে করা বউ নয় বলে ক্ষমাও করে দিয়েছেন।