ঘুম স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ছিলেন হরেন বোসসে লোকটা বড় ভালবাসতেন দিগিনকে। প্রায়ই বলতেন, বিয়ে না করে এক রকম ভালই আছ হে দিগিন, কিন্তু চল্লিশের পর ভুগবে। সাহেবরা চল্লিশ পর্যন্ত একা থাকে, ফুর্তি ললাটে, ফুর্তির অভাবও ওদেশে নেই, কিন্তু চল্লিশের পব ঠিক টুক করে বিয়েটি করে ফেলে। কারণ মানুষ ওই বয়স থেকে লোনলি হতে শুরু করে।
অক্টোবর না নভেম্বরের শীতে ঘুম একটা সৃষ্টিছাড়া জায়গা। দিগিন কার্যব্যাপদেশে পাহাড় লাইনে গিয়ে ঘুমে একটা-দুটো দিন কাটাতেন। চার ধারে জন-মনিষ্যি নেই, পাতলা বরফের আস্তরণ পড়ত কোনও কোনও বছর শীতকালে। ওয়েটিংরুমে আগুন জ্বেলে বোতল নিয়ে বসতেন দুজনে। কথা হত।
হরেন বোস এক দিন তার শালির সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুশকিল হল হরেন বোসের বউ ছিল নেপালি। যখন প্রথম ব্যাচেলার হরেন বোস ঘুমে আসেন তখন বয়স-টয়স কম। নেপালি ঝি ঘরের কাজকর্ম করত। দীর্ঘ শীতকালে, একাকিত্বে যখন মানুষকে কর্মনাশা ভূতে পায়, তেমনি একটা দুর্বল সময়ে তিনি সেই মেয়েটিকে উপভোগ করেন। মেয়েটা অরাজি ছিল না। কিন্তু তারপর তার বাড়ির লোকজন এসে হরেনকে ধরে, বিয়ে করতে হবে! করতে হল। গোটা দুই ছেলেমেয়েও হল তাদের। সেই বউয়ের একটা বোন ছিল। মনাস্টারিতে যাওয়ার রাস্তাটা হিলকার্ট রোডের যে জায়গা থেকে শুরু হয়েছে সেই মোডে একটা খুপরিতে পারিবারিক সবজির দোকানে বসত মেয়েটি। পনেরো-ষোলোর বেশি বয়স নয়, দীনদরিদ্র পোশাক পরে দু’গালে রক্তিমাভা আর সুন্দর মুখশ্রী নিয়ে বসে থাকত। সামনে সবুজ স্কোয়াশ, বাঁধাকপি, বিন, শুটি, ফুলকপি সাজাননা। তার মাঝখানে তাকে বেশ দেখাত। সেই দোকানের সামনে ছোকরা নেপালি কয়েকজন গাদা ফুল পায়ের আঘাতে শূন্যে তুলে তুলে চুঙ্গি খেলত খুব। মেয়েটি সব বুঝে হাসত। হরেন বোস প্রস্তাব দিয়ে বলেন, আত্মীয় যখন হয়ে গেছে তখন ফেলতে পারি না। ওদের সম্প্রদায়ে উপযুক্ত ছেলে বড় কম, বিয়ে যদি করেও তার রোজগার করাবে। বিয়ে না দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। পয়সার লালচ তো বড় কম নয়। দোকানে বসে থাকে বলে লোকে নিচু নজরে দেখে, কু-প্রস্তাব দেয়, পয়সা দেখায়। তোমারও উদ্যোগ করে বিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। মেয়েটা কচি আছে, শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারবে।
দিগিন রাজি হলেন।
সেই মেয়েটিই ময়না।
দিগিন সেবার পুজোর পর এক ভোররাতে টাইগার হিলে গেলেন সুর্যোদয় দেখতে। বহু বার দেখেছেন, তবু গেলেন। সঙ্গে ময়না ছিল। টাইগার হিলে ওঠবার একটা খাড়া এবং শর্টকাট রাস্তা আছে। সেটা দিগিন চিনতেন না ময়না চিনত। সেই রাস্তা ধরে উঠতে দিগিনের হাঁপ ধরে যায়। মাঝে মাঝে বসেন, ময়নার সঙ্গে কথা বলেন, মাতৃভাষার মতো নেপালি ভাষা বলতে পারেন দিগিন, ময়না জানে ভাল বাংলা কথা। কথাবার্তার কোনও অসুবিধে হয়নি। আকাশে তখন ময়ূরকণ্ঠী রং ধরেছে। পালটে যাচ্ছে রং। শেষরাতে সূর্য ওঠার অনেক আগেই আকাশের ওই বর্ণালী দেখা যায়। কিন্তু সে সৌন্দর্য বড় একটা খেয়াল না করে দিগিন বলেন, থাকতে পারবে তো আমার সঙ্গে?
দিগিনের বয়স তখন বত্রিশ, ময়নার মেরেকেটে ষোলো, রাজি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ঘুমের। শীতের দেশে নিরন্তর দারিদ্র্য আর স্থবিরতা ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রবল ইচ্ছে তখন মেয়েটির। সে বলল, যদি আমাকে কলকাতা শহর দেখাবে বলল, তা হলে থাকব।
থাকা মানে কী জানো তো?
মেয়েটি চেয়ে থাকল।
দিগিন অবশ্য ব্যাখ্যা করলেন না। তিনি জানতেন, বিয়ে করার কোনও পদ্ধতি না মানলে ক্ষতি নেই। যে-কোনও রকম একটু অনুষ্ঠান করলেই চলবে। এবং সেটাই নিরাপদ। তার সন্দেহ ছিল, এই নিতান্ত অশিক্ষিত অভিজ্ঞতাহীন মেয়েটির সঙ্গে তাদের বংশগত যেটুকু আভিজাত্য আছে তা শেষ পর্যন্ত মিলবে কি না। দিগিনের একটা সুবিধে, তিনিও লেখাপড়া বিশেষ করেননি। ক্লাস এইট পর্যন্ত উঠে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। পড়াশুনো সেইখানেই শেষ হয়। অতঃপর ব্যাপক জীবনযাপন থেকেই তিনি তার স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ভেবে দেখেছিলেন, মেয়েটির কাছ থেকে একমাত্র শরীর আর কিছু সেবা তিনি পেতে পারেন। তার বেশি কিছু দেওয়ার সাধ্য মেয়েটির নেই।
দিগিন টাইগার হিলে ওঠার মাঝপথে মেয়েটিকে সেই গভীর শীতার্ত পরিবেশে একটি চুমু খান। বলেন, তোমাকে কলকাতা দেখাব।
সেই যে টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখতে গেলেন, সেখান থেকে আর ঘুমে ফিরে এলেন না দিগিন। এক ছোকরার জিপে ফিরলেন দার্জিলিং। সেখান থেকে আবার জিপ ভাড়া করে ময়নাকে নিয়ে টানা নেমে এলেন শিলিগুড়িতে। বত্রিশ বছর বয়সে বিয়ের ঝামেলায় যেতে তার ভরসা হল না। ময়নার বয়স তখন নিতান্ত কম। তাকে যা-তা বুঝিয়েছিলেন। ময়না তখন ঘুম ছাড়ার জন্য ব্যগ্র। তা ছাড়া সে জানত যে এই লোকটাই তার হবু স্বামী, তাই আপত্তি করেনি।
টংগি ঘরটায় ময়নাকে নিয়ে থাকার বিপদ ছিল। আস্তানাটা সবাই চেনে, হরেন বোস, মেয়েটির আত্মীয়স্বজন সেখানে যে-কোনও সময়ে হাজির হতে পারে। পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারে। তবু দিগিন ময়নাকে নিয়ে উঠলেন সেখানেই।
তিন দিন পর হরেন বোস হাজির হলেন এসে।
কী খবর ভায়া?
ভালই।
ময়না?
আছে।
হরেন বোস মাথা নেড়ে বললেন, জানতাম।:–বলে একটু শাস ছাড়লেন।