বহুকাল শালুগাড়ার বাকসিদ্ধাইয়ের কাছে যাওয়া হয় না। রেডিয়ো স্টেশন পেরিয়ে খানিক দূর এগিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে ঢালুতে নামিয়ে বাইকটা রাখেন দিগিন। তারপর সরু পথ ধরে বা ধারে নেমে যান। বড় রাস্তায় এক-আধটা মিলিটারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে বাকসিদ্ধাইয়ের কাছে মিলিটারির লোক এসেছে। ভিড় অবশ্য সারা দিনই থাকে।
আধমাইলটাক হেঁটে গাছপালায় আচ্ছন্ন শান্ত জায়গায় পৌঁছে যান তিনি। অনেককাল আসা হয়নি। অবাক হয়ে দেখেন, এদের বাড়িঘরের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। সচ্ছলতার চিহ্নগুলি দেখলেই বোঝা যায়। কেবলমাত্র লোকের ভবিষ্যৎ বলে দিয়ে উইদাউট ক্যাপিট্যালে বেশ দাঁড়িয়েছে এরা।
বাইরে খোলা একটা ঘর। আনাড়ি মিস্ত্রির তৈরি দু-চারখানা বেঞ্চি পাতা। মিলিটারি, মেয়েছেলে, বুড়ো, বাচ্চা, জনা পঁচিশ লোক বসে আছে। অল্পবয়সি বাকসিদ্ধাই মেয়েটি হাতে সেই পুরনো একটা শিবলিঙ্গের মতো পাথরের দিকে চেয়ে কথা বলছে। দিগিনের কানে এ রকম একটু সংলাপ ভেসে আসে
মহিলাকণ্ঠ-সে কেমন দেখতে?
বাকসিদ্ধাই-রোগা, ফরসা, চোখে চশমা।
মহিলাকণ্ঠ-আমার ছেলের সঙ্গে মানায়?
বাকসিদ্ধাই—মানায়।
জাত?
স্বঘর।
মহিলাকণ্ঠ সনিশ্বাসে বলে, বিয়েটা হবে?
হবে।
দিগিন ঘরটায় না ঢুকে এগিয়ে যান। উত্তর দিকে বাঁশঝাড়ে আচ্ছন্ন ছায়ায় ঢাকা পথে কতকগুলো বাচ্চা ছেলে খেলছে। উত্তর প্রান্তে খেত। উদাস মাঠ, তার ও পাশে কালো মেঘের মতো হিমালয় ঘনিয়ে উঠেছে উত্তরের আকাশে। গত সাতাশ বছর ধরে দেখছেন দিগিন। দাঁড়িয়ে একটা মাদ্রাজি চুরুট শেষ করেন তিনি।
আবার যখন এসে খোলা ঘরখানায় উকি দিলেন তখন ভিড় অনেক পাতলা হয়েছে। অবাঙালি কাঠখোট্টা এক মিলিটারি সওয়াল-জবাব করছে। তার ঘর থেকে চিঠি এসেছে, ছেলের অসুখ। সিদ্ধাই মাথা নেড়ে জানায়, সেরে যাবে। চনিপড়া নিয়ে যায় যেন।
পিছনের একটা বেঞ্চে একা বসে দিগিন চুরুট টানেন! সিদ্ধাই তাকে চেনে। এক বার মুখ তুলে দেখে হাসল।
ভিড় পাতলা হলে সিদ্ধাই মুখ তুলে বলে, ভাল তো?
দিগিন মাথা নেড়ে জানালেন, না।
কী হয়েছে?
আমার ভাইপো
বলতে গিয়ে ক্লান্তি বোধ করে থেমে যান দিগিন। এ সব প্রশ্নের কোনও মানে নেই। সোপস্টোন চুলোয় যাক, পুন্নির বিয়ে নিয়েও প্রশ্ন করার প্রবৃত্তি হয় না তার।
চুরুটটা মুখ থেকে নামিয়ে দিগিন চোখ বুজে বলেন, মা, আমার মরণ কবে?
সিদ্ধাই হাতের পাথরটার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর বলে, সে দেরি আছে।
কত দেরি?
অনেক দেরি, তবে একটা ডাঙর মেয়েছেলে ক্ষতি করবে।
ডাঙর মেয়েছেলে? সে কে?
ফরসা, লম্বা মেয়েছেলে একজন, পাহাড়ি মেয়েছেলে।
দিগিন হাসেন, ময়নার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কে না জানে। ময়না একসময়ে বিখ্যাত ছিল। সবাই তার চেহারাটা জানে। দিগিন একটু শ্বাস ফেলে বলেন, কীরকম ক্ষতি?
পয়সাকড়ি আর নাম-যশের ক্ষতি।
বিষ-টিষ খাওয়াবে না তো?
সিদ্ধাই ইতস্তত করে বলে, সাবধানে থাকবেন, তবে আপনার এখনও অনেক আয়ু আছে।
দিগিনের ক্লান্তি লাগে। একটা পাঁচ টাকার নোেট এগিয়ে দেন। সিদ্ধাইয়ের বুড়ো বাপ বসে আছে পিছনে, টাকাটা সে নেয়। বলে, আর কিছু জানবেন না?
না। আটান্ন বছর বয়সে আর কী জানবার আছে, আমার তো কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
বুড়ো মাথা নাড়ে।
সিদ্ধাই মেয়েটি তার কমনীয় মুখশ্রী তুলে বলে, শরীরে একরকম জ্বালা রোগ হবে। জল পড়ে দেব, নিয়ে যাবেন।
দিগিন অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়েন। জ্বালা রোগ হওয়ার বাধা কী? যত অ্যালকোহল রক্তে জমা হয়েছে তাতে অনেক কিছু হতে পারে।
দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পুন্নি এসে যখন ডেকে তুলল তখন সাড়ে তিনটে। চারটের আগে তিনি ওঠেন না বড় একটা, ঘড়িটা দেখে বিরক্ত হলেন। বললেন, কী রে?
ওঠো, তোমার চা হয়ে গেছে।
চা, তার এত তাড়া কী?
বাঃ, আজ কে সব আসবে বিকেলে। বেলা পর্যন্ত ঘুমোলে চলবে কী করে?
দিগিন হাসলেন। ত্রিশ টাকা কিলোর চায়ের গন্ধে ঘর ম ম করে। বলেন, যার আসবার আসবে। তোর অত মাথাব্যথার কী? আমি তো দকলীকে বলে রেখেছি, সে রাজিও হয়েছে।
পুন্নি বলে, ঠিক আছে।
কিন্তু পুন্নির মুখে রাগ।
দিগিন কিছু বলেন না, পুন্নিই গজগজ করে, রোজ সং সেজে অচেনা মানুষের সামনে গিয়ে বসা কার ভাল লাগে।
তোকে বসতে কেউ বলেছে?
না বসলে তোমাদের প্রেস্টিজ থাকবে নাকি?
ও। তা সেই কথা ভেবেই বুঝি হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছিস?
হুড়োহুড়ি আবার কী! পুন্নি ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির সঙ্গে বলে, চা-টা খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
পুন্নি চলে গেলে উত্তরমুখো ইজিচেয়ারটায় আবার বসেন দিগিন। টুলের ওপর পা তুলে দেন। হিমালয় সারা দিন লুকোচুরি খেলে এই শরৎকালে। বরফে ঢাকা দূরের পাহাড়গুলি ঢেকে গেছে। কুয়াশার মতো ভাপে। দেখা যায় শুধু নীল পাহাড়ের সারি। দিগিন দেখেন, দেখতে কখনও ক্লান্তি লাগে না। অবসরপ্রাপ্তের মতো বসে থেকে সময় বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সময় ঠিক হিমালয়ের মতো পাথর হয়ে জমে আছে। এভাবে কর্মহীন এবং অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার কথা তার নয়। বয়স মাত্র আটান্ন, শরীরটাও যথেষ্ট মজবুত, তবু মনে মনে একরকম কর্মত্যাগ এবং বৈরাগ্য এসে গেছে।
শিলিগুড়িতে যখন তিনি প্রথম এসেছিলেন তখন এটা ছিল গঞ্জ মতো জায়গা। বাগরাকোটে কয়লাখনির সন্ধান, সিকিমের কমলালেবুর চালান, কাঠের ব্যাবসা, চা বাগানের মালিকানা কোনও চেষ্টাই তার কম ছিল না। অবশেষে বংশগত পাগলামির খেয়ালবশে এক বার মধ্যপ্রদেশও চলে যান হিরের সন্ধান পেয়ে। সে ভীষণ কষ্ট গেছে। তাঁবুতে থাকতেন, খাদ্যাখাদ্যের বিচার ছিল না, হাতখানেক দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেল, তবু হিরের নেশায় পাগল ছিলেন কিছুকাল। হিরে পাননি তা নয়। ছোট ছোট কম দামি কয়েকটা পেয়েছিলেন, তাতে খরচটা কোনওক্রমে উঠেছিল হয়তো। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতি হয়ে গেল শরীরের। জন্ডিস ধরল। মাস ছয়েক সেই রোগে শয্যাশায়ি রইলেন প্রায়। লিভারটা সেই থেকে খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তাররা তার নেশাভাং একদম বারণ করে দিলেন। কিছুকাল সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর এক দিন মনে হল, একা মানুষ, শরীর বাঁচিয়ে রেখে কী হবে! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গভীর একাকিত্ব একটা কালো কম্বলের মতো যেন চেপে ধরে। লিভারটা জখম আছে আজও, তবু দিগিন কিছু মানেন না।