কী খবর দিগিনবাবু?
কাঞ্চনের সাফল্যের ছবিটা চোখের সামনে জ্বলছে, দিগিন তাই বিষয় গলায় বলেন, এই তো।
ভটচায দিগিনের অন্যমনস্কতা লক্ষ করলেন। কিন্তু বেশি কথার মধ্যে গেলেন না। তিন জন লোক ঘরে বসে আছে, কর্মচারীরা ব্যস্ত হয়ে আসছে কাগজপত্র সই করাতে। ব্যস্ত ভটচায় বললেন, এবার পুজোয় চলে যাচ্ছি, বুঝলেন?
হু।
আপনাদের শিলিগুড়ি ছাড়ছি শেষ পর্যন্ত।
বলে ভটচায ব্যস্ত রইলেন কিছুক্ষণ। মিনিট কুড়ি পর একটু ফাঁক পেলেন। সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, একটা খান। চুরুট খেয়ে বুক তো পুড়িয়ে ফেলেছেন।
দিগিন মাথা নাড়লেন। নিজের সরু মাদ্রাজি চুরুট ছাড়া অন্য কিছু তেমন ভাল লাগে না। ফসফসে ধোঁয়ায় ভারী বিরক্তি আসে।
ভটচার্য বলেন, নেশাটেশা করেন বটে, কিন্তু চেহারাটা এখনও ঠিক রেখেছেন। এখানকার জল-হাওয়ায় কী করে ফিট থাকেন মশাই?
ফিট থাকি নেশা করি বলেই।
সব নেশাখোরই ও কথা বলে।
মাইরি। মদ শরীরের সব জীবাণু নষ্ট করে দেয়।
কিন্তু মদটা তো থাকে পেটে।
হ্যাঁ। লিভারের বারোটা বাজায় আস্তে আস্তে। তবে মদ খেলে মদের এফেক্ট ছাড়া অন্য কোনও রোগ বড় একটা হয় না।
ভটচায় একটু আগ্রহ দেখিয়ে বলেন, সত্যি?
দিগিন চুরুটটা আরামে টেনে হেসে বলেন, কোনও মাতালের ছোটখাটো অসুখ দেখেছেন কখনও? জেনুইন মাতালের ও সব হয় না। মদ খুব বড় জীবাণুনাশক।
দুর।
মদে ভিজিয়ে রাখলে কোনও জিনিস সহজে নষ্ট হয় না জানেন? তাই ওষুধে অ্যালকোহল থাকে প্রিজারভার হিসেবে।
ভটচায় চিন্তিত মুখে বলেন, তা বটে।
তবেই দেখুন। স্টমাকটাকে মদে ড়ুবিয়ে রাখলে তার প্রিজারভেশনের ক্ষমতা বাড়ে কি না।
আফিং খেলে পেটের রোগ সারে শুনেছি।
তাও খেতে পারেন। তবে ও হচ্ছে ঝিমুনি নেশা।
না না, নেশার জন্য নয়। ওষুধ হিসেবে।
দিগিন মৃদু হেসে বলে, অ্যালকোহল আরও ভাল। আজ রাতে আসুন আমার ওখানে, একটা মজার জিনিস খাওয়াব। দেশি জিনিস, সঙ্গে একটা পাতার রস মিশিয়ে দেব। দেখবেন, কাল সকালে কেমন ফাইন হাগা হয়।
দিগিনকে সঠিক বিশ্বাস করতে পারেন না ভটচায়। সন্দেহের চোখে চেয়ে থাকেন। বলেন, আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে কোনও এক্সপেরিমেন্ট করবেন না তো?
গিনিপিগ। বলে হা হা করে হাসেন দিগিন। মাথা নেড়ে বলেন, আরে না না।
ঘরে আবার লোকজন ঢুকে পড়ে। ভটচায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দিগিন আপনমনে হাত দু’খানা টিপেটুপে পরীক্ষা করে দেখেন। হাওয়াই শার্টের হাতা গুটিয়ে বাইসেপটা টেপেন একটু। না, আটান্নতেও তার মাংসপেশি বেশ শক্ত আছে। ঝুলে যায়নি। বুড়ো বয়সটা একটা ধারণা মাত্র। অত্যাচার এই বয়সেও তিনি কিছু কম করেন না। তবু শরীরটা টান-টান, হাটা-চলা-পরিশ্রম কোনও যুবকের চেয়ে কিছু কম পারেন না।
ভটচায এবার একটু ফাঁক পেয়ে বলেন, শেষ পর্যন্ত আমাকে বুড়ো বয়সে নেশাভাং ধরাবেন না তো মশাই।
দিগিন ভটচাযের সন্দেহকুটিল মুখখানা একটুক্ষণ দেখে নিয়ে বলেন, জীবনের একটা দিক একেবারে না-জানা থাকা কি ভাল? নেশার চোখে দুনিয়াটা কেমন দেখায় তা দেখে রাখা ভাল। নইলে যখন ওপরে যাবেন, যখন যম জিজ্ঞেস করবে, বাপু হে, দুনিয়াটায় কী কী রকম সব অভিজ্ঞতা হল, তখন তো ব্যাঙ্কিং ছাড়া আর কিছু বলার থাকবে না।
ভটচায মুখখানা স্মিতহাসিতে ভরিয়ে তুলে বলেন, বয়সকালে রোজগারপাতির সময়টায় নেশাভঙের পয়সা একরকম জোটানো যায়। আমার তো তা নয়। এই তো পারমানেন্টলি বসে যাচ্ছি, রিটায়ারের পর নেশার পয়সা জোগাবে কে?
ভূতে, নেশা লোকের ও ঠিক জুটে যায়।
না মশাই, আমার ও-সব দরকার নেই।
আচ্ছা, না হয় নেশা নাই করলেন, এক দিন একটু চাখলেই কি আর নেশা হয়ে যায়? নেশা করারও একটা প্রসেস আছে। চলে আসবেন আজকে, অন্তত এক দিনের জন্য আপনার পেটের গোলমাল মেরামত করে দেব। ওই সঙ্গে রাতের খাওয়াটাও সেরে যাবেন, নেমন্তন্ন রইল।
বলে দিগিন ওঠেন।
আচ্ছা যাব!–ভটচায হাসলেন।
ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে দিগিন আবার মোটরসাইকেলে ওঠেন। আজকাল আর তার অ্যাকাউন্টে টাকা বড় একটা জমা পড়ে না। বরং প্রতি মাসেই চার-পাঁচটা উইথড্রয়াল হয় কমপক্ষে। তাঁর নিজস্ব সংসার নয়, দাদারাও রোজগেরে, তবু কী কারণে যেন সংসারের খরচের সিংহভাগ তাকেই দিয়ে আসতে হচ্ছে বরাবর।
মোটরসাইকেলটা নিয়ে ইতস্তত একটু ঘুরে বেড়ান তিনি, এম-ই-এস-এর একটা কনস্ট্রাকশন চলছে বাগডোগরায়, ভাবলেন, সাইটটা দেখে আসবেন। কিন্তু মহানন্দা ব্রিজ পেরিয়েই তাঁর দীর্ঘ রাস্তাটা ভেবে ক্লান্তি লাগল। থাক গে, ঠিকাদারিটা যখন শানুই দেখছে তখন আর তার মাথা ঘামানোর কী আছে। সারাটা জীবন তো এই কর্মই করলেন।
বাইকটা ঘুরিয়ে নিলেন, শিলিগুড়ি যদিও তাঁর হাতের তেলোটার মতোই চেনা, তবু মাঝে তিনি কোথাও যাওয়ার জায়গা খুঁজে পান না। ভালও লাগে না। তাই খানিকক্ষণ এলোমেলো বাইকটা চালান দিগিন, শিলিগুড়ির শতকরা পঁচাত্তর ভাগ লোকই তার চেনা। বাইক থামিয়ে দু-চারজনের সঙ্গে কথা বলেন, কয়েকটা চেনা জায়গায় উঁকি দিয়ে ফেরেন, কয়েকটা দোকান থেকে টুকটাক কেনাকাটা করে নিলেন। তবু সময় ফুরোল না। বেলা এগারোটাই পেরোতে চায় না সহজে। শরৎকালটা তার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। সেবক রোড ধরে একটু এগোলে মহানন্দার অববাহিকায় উপত্যকার মতো বিশাল নিচু মাঠ আর বালিয়াড়ি দেখা যায়। বাইক থামিয়ে চেয়ে রইলেন সেই দিকে। মুঠোভর একটা মেঘ সকাল থেকে চেষ্টা করে এতক্ষণে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঢেকে ফেলেছে। উজ্জ্বল রোদে তিনধারিয়ার বিন্দু বিন্দু বাড়িঘর নজরে আসে।