ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে দিগিন যখন ভাগ্যান্বেষণে এই শিলিগুড়িতে আসেন তখন শিলিগুড়ি ছিল ছোট গঞ্জ শহর। একমাত্র স্টেশনটাই ছিল রমরমা। দার্জিলিঙের যাত্রীরা ব্রডগেজ থেকে নেমে ন্যারোগেজের খেলনা গাড়িতে ওঠার আগে এখানে ব্রেকফাস্ট সারত। যাত্রীদের মধ্যে তখন অধিকাংশ দাপুটে লালমুখো সাহেব। এ ছাড়া শহরটা ছিল ঘুমও, জনবিরল। তখনই এখানে কিছু ঠিকাদারির কাজ পেলেন দিগিন, কাঠের কারবারে নামলেন, কমলালেবু আর চায়ের ব্যাবসাতেও হাত দিয়েছিলেন। সেই সময়ে কাঠের টংগি ঘর সমেত হাকিমপাড়ার এই জমিটা তার হাতে আসে। একা থাকতেন, রান্নাবান্নার একটা লোক ছিল। দিব্যি জমে গেলেন এইখানে। তখন থেকেই বারান্দায় বা ঘরে বসে টেবিলে ঠ্যাং তুলে মেঘহীন দিনে নিজের পায়ের পাতার ফাঁক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা তার অভ্যাস। আর একা-বোকা থেকে থেকেই তার নানা নেশার পত্তন হয়। পচাই দিয়ে শুরু, গাঁজা, গুলি, মোক কিছুই বাদ রাখেননি। এখনও তার নেশার কিছু ঠিক নেই। যখন যেটা ইচ্ছে হয় খান। বাঁধাধরা জীবন ভাল লাগে না।
দেশভাগের পর হুড়মুড় করে বড় দুই ভাই, তাদের বউ, দুই বোন, স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিশাল এক দঙ্গল এসে পড়ল। একাকিত্বটা চলে গেল দেশছাড়া হয়ে। টংগি ঘরটার আশেপাশে আরও দু’খানা বাড়ি উঠল। অবশ্য একান্নবর্তিতা তাদের ভাঙেনি। বড় পাকশালে সকলের রান্না হয়। বড়দা উকিল, মেজোজনের ওষুধের স্টেশনারি, বড় ভগ্নিপতি কয়লার ব্যাবসা করে, ছোট ভগ্নিপতি অসুখে ভোগে বলে শালাদের ঘাড়ে পড়ে আছে। চাকরি তাকে করতেও দেওয়া হয় না।
.
সকালে সেবক রোডের মোড়ে কাঞ্চনের সঙ্গে দেখা। কাঞ্চনকুমার লালোয়ানি। মোটর-সাইকেলটা থামিয়ে দিগিন ডাকলেন, কাঞ্চন।
কাঞ্চন তার ভোকসওয়াগন থামিয়ে পান খেতে নেমেছিল মোড়ের দোকানটায়। পরনে খুব দামি একটা বিলিতি সিন্থেটিক ফেব্রিকের লাল গেঞ্জি, সাদা প্যারালেল ঘঁটের প্যান্ট, পায়ে চপ্পল, চোখে বড় মাপের রোদ-চশমা। জুলপি চুল সব হালফ্যাশনের। পিছু ফিরে দিগিনকে দেখেই দু খিলি পান তাড়াহুড়ো করে মুখে পুরে এগিয়ে আসে।
আরে দিগিনদাদা।
যাচ্ছিস কোথায়?
কাল রাতে জোর ধস নেমেছে তিনধারিয়ার কাছে। বাবাজি তো খার্সাঙে আটকা পড়ে আছে। আজ সুবায় ফিরবার কথা। যাচ্ছি ধসের সাইটে, যদি পায়দল এ পারে আসতে পারে তো নিয়ে আসব।
দিগিন বলল, ধস? কই আমি তো শুনিনি।
শুনবেন কী করে? আজকাল তো ঘরের বাইরে আসেনই না। দুনিয়ায় কত কিছু হয়ে যাচ্ছে। বুড়ো হয়ে গেলেন নাকি?
সাজগোজ যাই করুক কাঞ্চনের বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। হিলকার্ট রোডে একটা প্রকাণ্ড কাপড়ের দোকান দিয়েছে সম্প্রতি। আর আছে মদের দোকান, মোটর পার্টসের বিশাল প্রতিষ্ঠান। একসময়ে ওর মোটর পার্টসের কারবারে কিছু টাকা লগ্নি করেছিলেন দিগিন। কিন্তু সংসারের চাপে, দুঃসময়ে টাকাটা তুলে নিতে হয়েছিল। রাখতে পারলে আজ ভাল আয় হত।
দিগিন বলেন, বের হয়ে হবে কী? কাজকারবার কিছু নেই।
কাজ নেই কে বলে? অনেক কাজ পড়ে আছে। আসেন না একদিন গরিবের বাড়িতে। ডিসকাস করা যাবে।
দিগিন লক্ষ করেন, কাঞ্চনের জুলপির চুলে কলপ দেওয়া। কয়েকটা সাদা দেখা যেত আগে, এখন নেই। দিগিন বলেন, আসবখন। শানুটার জন্য বড় চিন্তা হয়। সোপস্টোনের পিছনে বহুত গচ্চা দিয়েছে।
কাঞ্চন হাসে, বলে, শানুর মাথায় পোকা। সোপস্টোনের কারবার কিছু প্রফিটেবল হলে শিলিগুড়ির মার্চেন্ট আর ঠিকাদাররা বসে আছে কেন? আমি তো আগেই জানি, টাকা জলে যাচ্ছে। দেখা হলে আমি তো বলি শানুকে। শানু রেগে যায়।
ঝকঝকে সবুজ ভোসওয়াগনটার দিকে চেয়ে দিগিন বলেন, বেশ আছিস কাঞ্চন।
হাঁ দাদা, ভাল আছি। তবে ভাল আর থাকা যাবে না।
ও কথা সবাই বলে।
জোর কম্পিটিশন। এখন সকলের হাতে টাকা। বাজার স্যাচুরেটেড।
গিমিক। দিগিন জানেন। গত সাতাশ বছরে শিলিগুড়ির বাতাসে টাকা কম ওড়েনি। তার চোখের সামনেই শিলিগুড়ি উত্তরবাংলার সবচেয়ে বড় ব্যাবসাকেন্দ্র হয়ে উঠা, কিন্তু তাঁদের পরিবার পুরনো ঠিকাদারির ব্যাবসা ছাড়া আর কিছু ধরতে পারল না। বড়দা অবশ্য ব্যাবসাতে নেই, ওকালতি করে তার একরকম চলে যায়। মেজোজন পুরনো বাজারে একটা স্টেশনারি দোকান দিয়ে বসে আছে বহুকাল। তেমন কিছু লাভ হয় না। শানু আর দুজন ভাইপোকে নিজের ঠিকাদারিতে নামাতে পেরেছেন দিগিন। ওরা যত লোভী তত চালাক নয়। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায় ওরা বিচিত্র সব কারবারে নাক গলাতে যায়। চোট হয়ে অবশ্য ফিরে আসে। দিগিনের অবশ্য এখন আর তাতে কিছু যায় আসে না। আটান্ন বছর বয়স, কিছু টাকা আছে, চলে যাবে। কিন্তু ভাইপোদের জন্য একরকম দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। কাঞ্চনকে তাই একটু ভাল করে দেখে নেন দিগিন। ছোকরা বেশ দাঁড়িয়েছে।
দিগিন বলেন, শানুটাকে ব্যাবসাতে নামিয়ে নিবি কাঞ্চন?
কাঞ্চন জর্দা-পানের পিক ফেলে বলে, শানু নামবে না।
দিগিন সেটা জানেন। একটু শ্বাস ফেলে মোটরসাইকেলের স্টার্টারে একটা লাথি মেরে বলেন, ততার সঙ্গে একদিন বসব।
আচ্ছা।
কাঞ্চন তার তোকসওয়াগনে উঠল। দিগিন হিলকার্ট রোড ধরে ব্যাঙ্কে এলেন।
সোমবার। বড্ড ভিড়। চেকটা জমা দিয়ে এজেন্টের ঘরে ঢুকে গেলেন। এজেন্ট ভটচায় বুড়ো হয়ে এসেছেন। মাস দুয়ের মধ্যেই রিটায়ার করে চলে যাবেন। ভটচাযের বুড়োটে ভাবটা অবশ্য বয়সের জন্য নয়। দিগিনেরও ওইরকমই বয়স। ভটচায় বুড়িয়ে গেছেন পেটের অসুখে আর হাঁপানিতে। শিলিগুড়ির ওয়েদারকে গালাগাল দেওয়া হচ্ছে তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়।