হেমন্তের হিমে পাতা খসছে! কী সুন্দর এই পাতা খসে পড়ার শব্দ। ঘুড়ির মতো মস্ত শালপাতা খসে পড়ছে। কুয়াশামাখা অন্ধকার-আক্রান্ত জ্যোৎস্নায় চারদিকে ভুতুড়ে ছায়া। শীত। একটা গাছের গুড়িতে ঠেস দিয়ে বসে রইলেন দিগিন। চুরুট ধরালেন। সাপখোপের কথা তার মনেও আসে না। কেবল মনে হয় সব কাজ সারা হয়েছে। অনেক দিন ঘুমোননি, বিশ্রাম নেননি। অনেক দিন যেন আবার কোনও শক্ত কাজও করেননি।
হঠাৎ চমকে উঠলেন। একটা স্পর্শ পেলেন কঁাধে! প্রথমটায় ভয় হল, সাপ? ভূত? শত্রু?
মুখ তুলে দেখলেন, ময়না। ঘোমটা খসিয়ে ফেলা মুখ খুব আবছা দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো মস্ত বড় করে চেয়ে আছে।
তোমার পায়ের শব্দ পাইনি তোবললেন দিগিন।
তুমি কি সজ্ঞানে ছিলে?
ময়না পাশে বসল। ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের একটা বাংলা সংস্করণ ছিল বাড়িতে। তাতে ঠিক এই ভঙ্গিতে সাকীর একটা ছবি ছিল। ওমরের হাঁটুতে হাত রেখে উন্মুখ হয়ে বসে আছে।
দিগিন ময়নাকে টেনে নিলেন বুকের কাছে। অনেক বয়স হয়ে গেছে। তবু দুরন্ত ঠোঁটে দীর্ঘস্থায়ি একটা চুম্বন করলেন। কোনও কামবোধ নেই। কেবলই একটি গভীর ভালবাসা থেকে উৎসারিত চুম্বন যেন। ময়নাও বোধ হয় তা বুঝল। বলল, এমন সুন্দর আর হয় না। এসো, আমিও তোমাকে
একটা চুমু দিই।
ঠোঁট বাড়িয়ে দিলেন দিগিন। অনেকক্ষণ ধরে আকুল চুমু দিল ময়না। চারদিকে ঘুড়ির মতো বড় বড় পাতা খসে পড়ছে তো পড়ছেই। শীত। কুয়াশা। জ্যোৎস্না।
.
কয়েক দিন পর। সকালবেলায় ঘরে ইজিচেয়ারে বসে আছেন দিগিন। উত্তরের দিকে চোখ। তেমনি পা দু’খানা সামনে তোলা। কাঞ্চনজঙ্ঘার শিরা-উপশিরা এবং ক্ষতচিহ্ন সবই আজ সকালের রোদে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিশাল একটা ঢালের ছায়া পড়েছে বুকে। পাহাড়টা যত সুন্দর ততই কুৎসিত। সাদা হাহাকারে ভরা একাকিত্ব। ওখানে তুষার ঝরছে, বয়ে যাচ্ছে মৃত্যুহিম বাতাস, একটিও গাছ নেই, পতঙ্গ নেই, প্রাণ নেই। ওরই পায়ের কাছে কোনও দুয়ে দুর্গম নির্জনতায় সৃষ্টি হচ্ছে তুষার নদী, পৃথিবীর প্রাণস্পন্দনের বীজকে অঙ্কুরিত করবে বলে সৃষ্টি হচ্ছে হ্রদ, নদী-উৎস। ওকে ঘিরে আঁছে নিস্তব্ধতা, কেবলই নিস্তব্ধতা।
কেউ ডাকেনি, তবু দিগিন ঠিকই শুনতে পেলেন ডাক। বহুকাল আগে ফটিক লাহিড়ি একটা সবুজ রঙের পুরনো হারকিউলিস সাইকেল চালাত। ফুলপ্যান্টে ক্লিপ আঁটা, মাথায় হ্যাট, সাইকেল করে শিলিগুড়ির রাস্তা তৈরির কাজ দেখে বেড়াত। সেই সাইকেলটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। আজ আবার তার ঘন্টি বাজল হঠাৎ। দিগিন ঠিকই শুনতে পেলেন। চমকালেন না। যেন ঘণ্টি বাজার কথাই ছিল।
বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে তিনি দেখলেন, ফটিক লাহিড়ি বিশ বছর আগেকার সেই চেহারায় দাঁড়িয়ে। ফুলপ্যান্টে ক্লিপ আটা, মাথায় হ্যাট।
আসছি।-বললেন দিগিন, তারপর কাউকে কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে বললেন, টানতে পারবে তো লাহিড়ি?
পারব।
দিগিন একটা শ্বাস ফেলেন।
লাহিড়ি সাইকেলটা চালাতে থাকে উত্তরের দিকে। রাস্তা ক্রমে চড়াইয়ে ওঠে। ছোট ঘোট পাহাড় ডিঙিয়ে যায়। ক্রমে চার ধারে সাদা তুষার জেগে ওঠে। কেবল তার মধ্যে সাইকেলের চেন ঘোরাবার একটা মিহি শব্দ হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার গা বেয়ে ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকে লাহিড়ির সাইকেল।
পারবে তো লাহিড়ি?—দিগিন জিজ্ঞেস করেন।
লাহিড়ি হাঁপ-ধরা গলায় বলে, পারব, পারতেই হবে।
বরং তুমি ক্যারিয়ারে বোসসা, আমি চালাই।
না হে, তোমাকেও তো এ রকম ট্রিপ মারতেই হবে। প্রথম দিনটা আমিই তোমাকে নিয়ে যাব।
আচ্ছা।
দিগিন আর কথা বলেন না। লাহিড়িও না। চারিদিকে কেবল এক সাদা, শীতল অন্ধকার জমে। আর কিছুই দেখা যায় না। না পাহাড়, না আকাশ, না পথ। সাইকেলের শব্দটাও শেষ হয়। দিগিন হাতটা বাড়ান। বিড়বিড় করে ডাকেন, লাহিড়ি।
কেউ উত্তর দেয় না।
দিগিন জানতেন এ রকমই হবে। বিড়বিড় করে বলেন, সাদা অন্ধকার। অদ্ভুত সাদা এক অন্ধকার।
পুন্নি চা নিয়ে এল।
কিন্তু দিগিন তা হাত বাড়িয়ে কোনও দিনই আর নিলেন না।