কত বয়সে বিয়ে হয়েছিল?
ষোলো–তেমনি ক্ষীণ উত্তর।
এখন কত বয়স?
একুশ।
বিয়ের ক’দিন পর স্বামী মারা যায়?
কাঠ কাঠ প্রশ্ন, পুরুষ গলায়। মেয়েটা এক বার করুণাভিক্ষু চোখদুটো তুলে তাকাল। পরমুহূর্তে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ছ’মাস।
কী হয়েছিল?
মেয়েটি বাঁ হাতটি তুলে চোখ মুছল। মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলল, আসাম অ্যাট্রোসাইটিসের সময়ে খুন হয়, তেজপুরে।
ও!–বলে দিগিন চুপ করে রইলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, তার কথা তোমার মনে পড়ে?
মেয়েটা উত্তর দিল না। চুপ করে নতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, দরজার একটা কাঠে ঠেস দিয়ে, যেন কোর্টে দাঁড়িয়ে জেরার উত্তর দিচ্ছে।
মনে পড়ে না?—দিগিন প্রায় ধমকালেন।
মেয়েটি তার সজল চোখ দুখানা তুলে তাকাল। কী মায়া থাকে চোখে! কী বিপুল ফঁাদ! দিগিনের বরফ গলতে শুরু করে।
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলে, না।
এত অল্প বয়সে তোমার বিয়ে দিল কে? কেনই বা!
আমার দাদামশাই। আমার বাবা চলে যাওয়ার পর…!
বলে মেয়েটি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থামল। পারিবারিক ব্যাপার এ লোকটাকে বলা ঠিক হবে কি না তা বুঝতে পারছিল না বোধ হয়।
দিগিন বললেন, আমি তোমার মা-বাবার সব ঘটনা জানি। বলো।
বাবা চলে যাওয়ার পর দাদামশাই আমাদের ভার নেন। অবশ্য আমরা তাঁর বাড়িতে যাইনি। কিন্তু তব কথামতো আমরা চলতাম। তিনি আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। গৌরীদান করারই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মা দেননি। তবু অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল।
দিগিন একটা শ্বাস ফেলে বললেন, যাও, কফি করে আনন।
মেয়েটা চলে গেল। পরিপূর্ণ গৃহকর্তার মতো বসে রইলেন দিগিন। শীতটা বাড়ছে। ফেরার সময় একটু মাল টেনে নেবেন। এ সব রাতে আজকাল খুব জ্যোৎস্না ফুটছে। বহুকাল জঙ্গলে পাহাড়ে জ্যোৎস্না দেখেননি।
মেয়েটি কফি নিয়ে এল। দিগিন কাপটা হাতে নিয়ে তাপ দেখলেন, আগুন-গরম। খুব গরম ছাড়া খেতে পারেন না। খুশি হলেন।
নিঃশব্দে কফিটা খেয়ে উঠলেন। সকালে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে যেভাবে কাজের কথা বলেছেন অবিকল সেই স্বরে বললেন, কোথাও পালিয়ে-টালিয়ে যেয়ো না, ওতে লাভ হয় না। আমার বাসাতেই তোমার জায়গা হবে। শানু এলে বোলো।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, বিয়ের আগে শানুর সঙ্গে বেশি মিশো না, বুঝলে?
মেয়েটি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই অপরূপ লজ্জার দৃশ্যটি দাঁড়িয়ে দেখলেন না দিগিন। কে যেন তাঁকে জ্যোৎস্নায় ডাকছে। জঙ্গলে, পাহাড়ে, নিশুত রাতে।
বাইরে অবশ্য এখনও শেষ দুপুরের রক্তাভ রোদ।
জিপে উঠে দিগিন আর-একটা চুরুট ধরালেন। বললেন, চালা। মেহের সিং-এর দোকানে একটু থমাস।
কালিম্পঙের কনস্ট্রাকশনের কাজটা দেখার কথা তার মনে পড়ল না। সিং-এর দোকান থেকে একটা বড় পাইট কিনলেন দিগিন, আর দুটো ছোট। তারপর ফেরার পথে মাঝরাস্তায় জিপ দাড় করিয়ে ভ্রু কুঁচকে একটু কপিল আর রমণীর দিকে তাকালেন। তারা ইঙ্গিত বুঝল। বড্ড শীত পড়েছে। ছোট পাঁইট দুটো তুলে নিয়ে দুজনে জিপের পিছন দিকে চলে গেল। মালিকের সামনে খায় না।
.
কয়েক দিন পর। শালবাড়িতে আজ খুব জ্যোৎস্না ফুটেছে। প্রচণ্ড জ্যোৎস্না।
মোটর-সাইকেলটা খামারবাড়ির সামনে থামালেন দিগিন। পিছনের সিট থেকে ময়না নামল। তার গায়ে শাল, মুখ ঘোমটায় ঢাকা।
এখানেও প্ল্যাংকিং করা পুরনো ঘর একটা। কেউ থাকত না। এখন কপিল থাকে। খামারবাড়ির চারধারে জমি সদ্য কোপাননা। কয়েকদিনে দু’বিঘেটাক জমি কুপিয়ে ফেলেছে কপিল। আরও দু’ বিঘে কোপাবে। জমিটা ছাড়া হয়ে পড়ে ছিল।
নিস্তব্ধ খামারবাড়ির গভীর থেকে একটা খঞ্জনীর শব্দ আসছে। মৃদু কান্নার সুরে কপিল ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে…’ গাইছে। একদম একা। পরিপূর্ণ সুখী।
ময়না ঘোমটা ফেলে দিয়ে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নার প্লাবনে স্নান করে বলল, এখানে আনলে যে।
দিগিন ভ্রুকুটি করলেন। বললেন, কেন? খারাপ লাগছে?
ময়না মাথা নাড়ল। বলল, ভাবছি, আমার এত ভাগ্য!
দিগিন এ কথায় সাড়া দিলেন না।
পিছনে গভীর শালবন। বর্ষা পেয়ে আগাছা জন্মেছে খুব। সেদিকে চেয়ে বললেন, যাবে ওখানে?
ময়না বলল, তুমি গেলে যাব না কেন?
এসো।
বলে দিগিন হাঁটতে লাগলেন। শালবন খুবই গভীর। জ্যোৎস্না পৌঁছায়নি ভিতরে। স্বপ্নময় অন্ধকার। জোনাকি জ্বলছে, ঝিঝি ডাকছে। পেঁচার শব্দ আসছে। পাখির ডানার শব্দ।
দিগিন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে লাগলেন। পিছনে ময়না। ময়না পিছন থেকে দিগিনের একটা হাত ধরে বলল, আর যেয়ো না।
কেন?
সাপখোপ আছে।
দিগিন হাত ছাড়িয়ে নিলেন। বললেন, তুমি কপিলকে ডাকো, দরজা খুলে দেবে। ঘরে বসে থাকো গিয়ে। আমি আসছি।
ময়না অসহায়ের মতো বলল, যদি না আসো?
দিগিন ক্রু তুলে বললেন, আসব না কেন?
ময়না লজ্জা পেয়ে বলল, তুমি তো অদ্ভুত। তোমার সম্বন্ধে কোনও কথাই নিশ্চয় করে বলা যায় না।
ও বলে দিগিন ভাবলেন। বললেন, যদি না আসি তবে কপিল তোমাকে পৌঁছে দেবে।
ময়না দ্বিধাগ্রস্তের মতো শালবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে রইল। ফিরে গেল না। এলও না সঙ্গে।
মানুষ ওইরকম। অনেক দূর পর্যন্ত সঙ্গে আসে, কিন্তু সবটা পথ আসে না। জীবন থেকে তাই মানুষ খসতে থাকে, একটা বয়সের পর। দিগিন কোমর সমান আগাছা ভেদ করে এগোতে লাগলেন।
সংসারের কিছুই তাঁকে টানছে না। কেবল যেন এক মহা পর্বত, মহা আকাশ, মহা বৃক্ষ তাকে টানে।