সপ্তাহে দু-তিনবার।
বিধবা। তা হলে বয়স কত? বেশি?
না। কম।
বাচ্চা-কাচ্চা নেই?
না। বালবিধবা।
এ যুগে বালবিধবা হয় নাকি?
এ হয়েছে। নিখিল ব্যানার্জির মেয়ে।
নিখিল ব্যানার্জি! সে কে?
আপনার চেনা ছিল। মনীষা দিদিমণির বর। দিদিমণিকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে যে।
দিগিনের মনে পড়ল। উত্তরবাংলার প্রায় সব মানুষকেই চেনেন দিগিন। নিখিলকেও চিনলেন। খুব সুপুরুষ, খুব শিক্ষিত মানুষটা। কিন্তু চাকরি হয় জোটেনি, নয় তো করত না। মনীষা নামে মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছিল। কলকাতা থেকে দু’জন পালিয়ে আসে এই জঙ্গুলে দেশে। শিলিগুড়ি স্টেশনের প্লাটফর্মে নেমে দু’জন হাবাগোবা হয়ে বসে আছে, জায়গা অচেনা, প্রেম পাংচার হয়ে বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে। দায়-দায়িত্বের চাপে চাকা বসে যাচ্ছে মাটিতে। নির্মল গাঙ্গুলি তার বাড়িতে নিয়ে তুলল সে অবস্থায়। পরের বাড়িতে নবদম্পতির প্রথম ফুলশয্যা হল। সেইখানে থাকতে থাকতেই দুজনের রোজ খিটিমিটি বাধত। গাঙ্গুলি অতিষ্ঠ হয়ে এসে বলত, মাইরি, কাদের জোটালুম।
প্রেম করে পালানো সে যুগে বিরল ঘটনা ছিল। গাঙ্গুলি এ ব্যাপারটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই ওদের আশ্রয় দেয়। কিন্তু ওদের বনিবনার অভাব দেখে বিগড়ে যায়। মনীষা নাকি খুব বড়লোকের মেয়ে, আর নিখিল বেকার, মধ্যবিত্ত। সে সময়ে সেই দুঃসাহসী আর দুঃসাহসিনীকে দেখার জন্য প্রায়ই দিগিন গেছেন ও বাড়ি। খুব স্মার্ট দম্পতি। দিব্যি কথাটথা বলত, কলকাত্তাই গুলচালও দিত। মাস দুই পর মনীষা চাকরি পেয়ে গেল কালিম্পঙে। বেকার স্বামীকে ঘাড়ে করে চলে গেল।
সুন্দর চেহারা ছাড়া, আর একটা ইসলামিক হিস্ট্রির এম এ ডিগ্রি ছাড়া নিখিলের আর কিছু ছিল না। চাকরির উৎসাহ ছিল খুবই কম। বসে খেত। বউ চাকরি করত। বছর সাতেক ধরে ওদের দু’জনের ঝগড়া হল। প্রেম কত দূর হয়েছিল কে জানে? তবে কালিম্পং থেকে যারা আসত তাদের কাছে মনীষা আর নিখিলের ঝগড়ার খবরই শোনা যেত। তারপর নিখিল এক আসামি মেয়ের সঙ্গে গৌহাটি পালিয়ে গেল। সেখানে নাকি সুখেই আছে তারা। নতুন শ্বশুরের সম্পত্তি পেয়েছে। নিখিলের মেয়ের খবর অবশ্য রাখতেন না দিগিন।
শানু এখানে জুটল কী করে?
রমণীমোহন একটা ঢেকুর তুলে বলল, সাইটের কাছেই বাড়ি। ও বাড়িতে জলটল খেতে যেতেন। তারপরই চেনা জানা।
কে কাকে ভজাল জানিস?
রমণীমোহন একবার আড়চোখে দিগিনের দিকে চেয়ে বলে, শানুবাবুর দোষ নেই। মেয়েটা দেখতে ভাল। নিখিল ব্যানার্জির মতো।
গাড়িটাকে একটা পাক খাইয়ে টিলার মাঝ বরাবর তুলে দাড় করাল রমণী! বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই বাড়ি।
দিগিন দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে নামলেন।
.
জিপের শব্দ শুনে কেউ উকি দিয়েছিল বোধ হয় জানালা দিয়ে। দিগিন মাথা নিচু করে ঢালু পথটা বেয়ে উঠছেন। এখনও লম্বাটে টান চেহারা, দূর থেকে দেখলে শানু বলেও ভুল হতে পারে। মাথায় একটা টুপি ছিল, চোখে কালো চশমা।
বাড়ির কাছে যেতে-না-যেতেই দরজা খুলে চমৎকার একখানা মুখ উকি দিল। মুখে একটু হাসি একখানা আয়ুহীন প্রজাপতির মতো থিরথির করে কাপছে।
দিগিন মুখ তুলতেই সেই প্রজাপতিটা মরে গেল ঝুপ করে। মেয়েটা মুখ নামিয়ে সরে পঁড়াল একটু।
দিগিন বললেন, মনীষা আছে?
মেয়েটা মাথা নাড়ল, নেই। এ সময়ে স্কুলে থাকে।
আমি শান্তি চ্যাটার্জির কাকা।
মেয়েটার মুখে এক অসম্ভব আতঙ্কের ছায়া খেলা করে গেল। এমনভাবে তাকাল যেন দিগিন যমপুরী থেকে পরোয়ানা নিয়ে এসেছেন। ব্যাধভীতা হরিণীর মতো পলকে সরে গেল ভিতরে।
দিগিন ক্লান্ত বোধ করলেন। বহুদিনকার পুরনো বকেয়া ক্লান্তির বোঝ। শ্লথ পায়ে দরজার চৌকাঠে উঠে দাঁড়ালেন।
ভিতর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে মেয়েটি বলল, আপনি বসুন। মা এখুনি আসবেন।
দিগিন পরদা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। ছোট্ট বসার ঘর, কাঠের মেঝে, কাঠের দেওয়াল, ওপরে টিন, বসবার ঘরে ছোট্ট ছোট্ট সোফাসেট, বইয়ের ব্ল্যাক, মেঝেয় সিকিমের কার্পেট পাতা। ফুলদানিতে ফুল! কেউ নেই।
দিগিন বসলেন, হাই তুললেন, কী করবেন তা এখনও ভাল করে জানেন না। একটা চুরুট ধরিয়ে ঠ্যাং-দুটো ছড়িয়ে দিলেন সামনে। মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে রইলেন খানিক। চোখ বুজেই টের পেলেন, তাঁকে কেউ দেখছে। অত্যন্ত মনোযোগে, অতি সাবধানে দেখছে।
চোখ না খুলেই বললেন, এসো মা, তোমার সঙ্গেই দুটো কথা বলি।
পরদার আড়ালে ভিতরের ঘর থেকে একটা অস্ফুট ভয়ার্ত শব্দ হল। তারপর খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর আস্তে একখানা সুন্দর ফরসা হাত পরদাটা সরাল। রঙিন ছাপা শাড়ি পরা, ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটি ঘরের মধ্যে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
দিগিন চুরুটের ঘন ধোঁয়া ছাড়লেন। অল্প একটু কাশি এল। সামলে নিয়ে বললেন, নামটি কী?
অধরা ব্যানার্জি।
দিগিন ভ্রূ কোঁচকালেন। চুরুটের দিকে চেয়ে বললেন, তোমার কি স্বগোত্রে বিয়ে হয়েছিল?
আবার একটা অস্ফুট কাতর শব্দ, ভয়ের। ধরা পড়ার। মেয়েটি তার সুন্দর মুখটি নত করে দু’ধারে দু’বার ফেরাল। অর্থাৎ না।
তোমার স্বামীর পদবি কী ছিল?–দিগিন জিজ্ঞেস করলেন।
ভট্টাচার্য।—ক্ষীণ কণ্ঠের উত্তর এল।
তা হলে ব্যানার্জি বললে কেন? ইচ্ছে করলেই কি পদবি বদলানোনা যায়?
বলে চেয়ে রইলেন দিগিন। বয়স কম। বোধ হয় বাইশের বেশি কিছুতেই নয়। সাদা ধপধপে সিথি। কুমারীর মতো।