দিগিন বললেন, তোকে একটা বাগান বানাতে দেব। শালবাড়িতে জমিটা পড়ে আছে, গেছিস তো।
কপিল হুঁ দিল।
ওখানে একটা বাগান বানাবি, পলাশ লাগাবি, শিউলি, বেলফুল…
মল্লিকা। কপিল বাধা দিয়ে বলল।
দিগিন ভুলে গিয়েছিলেন, বেলফুলই মল্লিকাফুল।
দিগিন একবার ফিরে দেখলেন, কপিলের চোখদুটো চকচক করছে। মুখখানা লোভাতুর। বাগান! বাগান! এ পৃথিবীতে একমাত্র একখানা বাগান বানানোর মতো গভীর কাজ আর কী আছে? সে আর কিছু চায় না। একখানা বাগানমাত্র।
দিগিন অনেকক্ষণ কপিলের মুখের দিকে পিছু ফিরে চেয়ে দেখেন। কপিলের মুখটা পালটে যাচ্ছে। চতুর ধূর্ত মুখখানা কতগুলো লাবণ্যের রেখায় ড়ুবে গেল। খুব তৃপ্তি পেলেন দিগিন। গাঢ়স্বরে বললেন, পারবি না?
খুব।
কাল চলে যাস শালবাড়িতে। কাল থেকেই লেগে যা।
আবেগে কপিল বুঝি কথা বলতে পারল না। চোখটা মুছল। মল্লিকা! মেয়েটা। জিপগাড়ি না হলে এখন সে দিগিনের পায়ে মুখ ঘষত। পলাশ লাগাবে, শিউলি লাগাবে, আর সেইসঙ্গে গ্রীষ্মের মল্লিকাফুল, সাদা ঘ্রাণে ভরা। মেয়েটার কথা মনে পড়বে। এই মাটিতেই তো মিশে আছে মেয়েটা।
গাড়ি চড়াই ভাঙছে। পাহাড়ি গোরর একটা পাল রাস্তা পার হয়ে নেমে যাচ্ছে বনভূমিতে। তাদের গলার ঘণ্টার শব্দ। রোদ লেগে বনভূমি মথিত হয়। গভীর উদ্ভিদজগতের নেশাড়ু গন্ধ আসে। এক পাহাড়ের ঢালের ছায়ায় গভীর শীতল রাস্তা। ওপরে আকাশ আর তিস্তার ও পারে রোদ ঝলসাচ্ছে। টিপ টিপ করে চুইয়ে নামছে একটা জলধারা, পাহাড়ের গা বেয়ে, তার ওপর একটুখানি কালভার্ট, জিপটা গুমগুম শব্দ করে কালভার্ট পার হয়ে গেল। শীত বাড়ছে, শার্টের বোতামটা এঁটে নিলেন, বুকে হাত জড়ো করে বসলেন দিগিন।
কালিম্পঙের দিকে বাঁক নিচ্ছে গাড়ি। বেশি দেরি নেই, জাগ্রত চোখে চেয়ে আছেন দিগিন। বহুকাল আসেন না। যা দেখছেন তা-ই যেন ভিতরটাকে নেড়ে দিচ্ছে। ঘুলিয়ে উঠছে সব। স্মৃতি আর বর্তমান হয়ে যাচ্ছে একাকার।
নড়ে বসলেন দিগিন। হাই উঠছে। ওই দেখা যাচ্ছে কালিম্পঙের ঢাল। ধানখেত। ধান চাষ বা আবাদ পাহাড়ি জায়গায় বড় একটা দেখা যায় না। কালিম্পং ব্যতিক্রম। এই জন্যই দিগিনের কালিম্পঙের প্রতি কিছু পক্ষপাত আছে।
রবীন্দ্রনাথের বাড়ি চিত্রভানুর সামনে গাড়িটা দাড় করিয়ে নামলেন। বাগানে সেই শ্বেতপাথরের কেদারা। আর একটা শ্বেতপাথরের ট্যাবলেটে কালিম্পং নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটার ওপর দুপুরের রোদ পড়েছে। সেই যখন রবিবাবু আসতেন তখন এসে তাকে এইখানে দেখে গেছেন। দিগিন। ওই শ্বেতপাথরের কেদারায় গদি পেতে বসতেন। আদিগন্ত প্রকৃতির বিস্তার থাকত সামনে। প্রতিমাদেবীকে দেখেছেন ওই কেদারার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন কখনও। কী সুন্দর, আর করুণ মুখশ্রী!
সেই রবীন্দ্রনাথের সেন্টেনারি হয়ে গেল! সময় কত তাড়াতাড়ি যায়। বাগানে কেউ নেই। চমৎকার বাড়িটায় একটু বয়সের দাগ পড়েছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি লম্বা দাড়িওলা জোব্বা রা মূর্তি ধীর গভীর রাজার মতো বেরিয়ে আসবেন।
দিগিন জিপে উঠলেন এসে। ডাকলেন, রমণী।
আজ্ঞে।
শানু এখানে কোথায় আসে রে?
রমণীমোহন চুপ করে থাকে।
সেখানে চল।–বলে দিগিন হেলান দিয়ে বসে চোখ বোজেন। রমণীমোহন স্টার্টারে চাপ দেয়। গাড়ি কেঁপে ওঠে।
হঠাৎ দিগিনের খেয়াল হয়, বলেন, তোরা কিছু খাসনি?
রমণী মাথা চুলকে বলে, আপনারও হয়নি।
দিগিন হাসলেন। বললেন, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি নাকি রে? খাওয়ার কথা মনে থাকে না! চল।
ভাল হোটেলে তিনজন বয়সের মতো সমান সমানে বসে খেলেন। দিগিন সামান্যই খান। কিন্তু রমণী আর কপিল দু’পাশে পাহাড় পর্বত গিলে ফেলতে লাগল। এই খিদেটা চেপে ছিল ওরা এতক্ষণ। বেলা একটা বাজতে চলল। ওরা কিছু বলতে জানে না। চিরকালই ওদের ওইরকম সব সম্পর্ক দিগিনের সঙ্গে। কর্মচারী, তবু কিছু বেশি। চাকর, তবু যেন অন্য রকম। শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা তলিয়ে দেখেননি দিগিন। গোলমেলে! একটা জিনিস জানেন ওরা তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে।
ফের জিপে উঠে রমণীমোহন দিগিনের দিকে তাকিয়ে বলে, সেইখানে তো?
কোথায় যাওয়ার কথা তা খেয়াল ছিল না দিগিনের। বড় রাস্তার ধারেই একটা নানারি। খুব বড় বড় পাইন আর দেবদারু গাছের ছায়ায় টালির চালওলা বাড়ি। বহুকাল আগে এক ফরাসি বুড়ি নানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তখনকার এ-টি-এস সাহেব পেরেরা।
বুড়ির কিছু মাল চুরি গিয়েছিল কলকাতা থেকে আসবার সময়ে ট্রেনে। বুড়ি রিপোর্ট করে। সাধারণত ট্রেন থেকে যাত্রীদের মাল চুরি গেলে রেল ক্ষতিপূরণ দেয় না। কিন্তু বুড়ি বিদেশি বলে, আর নান বলেই বোধহয় দিয়েছিল। পেরেরা সাহেবের দেহরক্ষী হয়ে রাইফেল হাতে দিগিন এসেছিলেন। সেই ফরাসি সন্ন্যাসিনীর অনাবিল হাসি আজও বুকে লেগে আছে, ত্রিশ বছর পরেও। ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে করা কেক আর কফি খাইয়েছিল বুড়ি। অনেক আশীর্বাদ করেছিল।
অন্যমনস্কতা থেকে দিগিন ফিরে এসে বলেন, কোথায়?
সেই মিসট্রেসের বাড়ি!– রমণী বলে।
কোন মিসট্রেস?
যেখানে শানুবাবু আসেন।
ওঃ—দিগিন বুঝতে পেরে বলেন, মেয়েটা মিসট্রেস বুঝি?
না। মেয়েটা মিসট্রেসের মেয়ে। বিধবা।
দিগিন বিস্বাদ মুখে বলেন, শানু প্রায়ই আসে?