দিগিন বুঝলেন কাঁচা টাকার স্রোতে চৌধুরী ড়ুবছেন।
দিগিন অবশ্য চৌধুরীকে রিভলভারের লাইসেন্স বের করে দিয়েছিলেন। সেই রিভলভার শিয়রে নিয়ে শুতেন আর দুঃস্বপ্ন দেখতেন চৌধুরী। মানুষটার জন্য তখন কষ্ট হত। হাভাতের হঠাৎ বিপুল টাকা হলে তার বড় একটা সুখ হয় না, অসুখ উপস্থিত হয়।
চৌধুরীরও হল, পোস্টিং পাওয়ার বছরখানেকের মধ্যে প্রথম স্ট্রোক। কিন্তু চৌধুরী সিক-লিভ নেবেন না, ওই অবস্থাতেই কাজ করার জন্য ব্যস্ত। বহু বলে-কয়ে তাকে হাসপাতালে দেওয়া হল। কলকাতা থেকে কেউ এল না, এলে নাকি বাড়ির কাজে ব্যাঘাত হবে।
সে যাত্রা বেঁচে গেলেন চৌধুরী। রাশি রাশি টাকা কলকাতায় পাঠান, বড় ছেলে আনাগোনা করে, স্টেশনের অন্যান্য স্টাফ খুব অসন্তুষ্ট, তারা নাকি ভাগ পায় না। চৌধুরীর এখন টাকা ছাড়া মুখে কথা নেই, কিন্তু চেহারাটায় একটা রুণ খড়ি-ওঠা ভাব, চোখে ক্ষয়রোগীর চোখের মতো অসুস্থ উজ্জ্বলতা।
এ সময়ে খবর এল, বোনের ছেলেরা বাড়ি দখল করেছে, তারা ভাড়াটে বসাতে দেবে না। বলছে, আমাদের মায়ের নামে বাড়ি, আমাদের ইচ্ছেমতো হবে।
চৌধুরী ছুটে গেলেন কলকাতায়, ভাগনেদের হাতে-পায়ে ধরলেন। বোন বললেন, দাদা, আমি কী করব? ছেলেরা আমার কথা শোনে না।
ভগ্নমনোরথ চৌধুরী ফিরে এলেন একা। মাথায় টাক পড়ে গেছে, ক’দিনে চোখের কোলে কালি, অসুস্থ-অস্বাভাবিক চেহারা।
রিভলভারটা সেইসময়েই প্রথম কাজে লাগল। রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এসেছিল, মোটে আর মাসখানেক আছে। তারপরই পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে গিয়ে কলকাতায় হাজির হবেন, সেখানে বাড়িঘর, ছেলেমেয়ে বউ, সংসার। একটা মাস কাটিয়ে যেতে পারলেই হত। কিন্তু ওই বাড়ির শোকটাই সামলাতে পারলেন না। রিভলভারটা কপালে ঠেকিয়ে ঘোড়া টেনে দিলেন এক নিশুতরাতে।
দিগিন হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন আপনমনে। ঘটনাটা মনে পড়লেই দুঃখের বদলে তার প্রবল হাসি পায়। চৌধুরী বেশ ছিল শিলিগুড়ির মাস্টার হয়ে। কিছু অভাব ছিল না, তারপর হলদিবাড়ি গিয়ে খুব বড়লোক হল, সেও ভালই, কিন্তু সেই বড়লোকির একটু লোকসান, বিধবা বোনের নামের একটা বাড়ি হাতছাড়া হয়ে গেল, সেটুকু সহ্য করতে পারল না। বাড়িটা গেছে তো যাক না, তবু তো তোমার অনেক থাকছে, তুমি তো শিলিগুড়ির মাস্টার থাকা অবস্থায় ফিরে যাচ্ছ না। তবু মানুষের ওইরকম হয়। গরিব থেকে বড়লোক হলে ফের একটু গরিব হওয়া তার সহ্য হয় না।
জুয়াড়ি নির্মল গাঙ্গুলি তিতাস খেলেই বড়লোক হয়েছিল। তার একটা পেটেন্ট কথা ছিল, এমনি লস সহ্য হয় ভাই। কিন্তু লভ্যাংশের লস সহ্য হয় না। গাঙ্গুলি যেদিন হারত সেদিন স্পাের্টসম্যানের মতো হারত। কিন্তু যেদিন প্রথমে জিতে পরে হাবত সেদিন বড় মনমরা থাকত। বলত, ঈশ্বর আমাদের সহ্যশক্তি বড় কম দিয়েছেন। ক্ষতি সহ্য হয়, কিন্তু লাভের ক্ষতি সহ্য হয় না। ছেলেবেলায় একটা হাবা ছেলেকে সবাই খেপাতাম। সে বড় পয়সা ভালবাসত। সবাই তাকে বলত পয়সা নিবি? অমনি সে হাত পাতে! আমি বলতাম। সে হাত পাতত। পয়সা দিয়ে ফের নিয়ে নিতাম, আবার দিতাম, ফের নিয়ে নিতাম। শেষবারটা মজা করার জন্য পয়সাটা নিয়ে নিতাম। দিতাম না। সে খেপে গিয়ে বলে বেতি, নেম্মলটা খচ্চড়। দে’লে নে’লে, দেলে নে’লে, ফের দেলে, ফের নে’লে। নে’লে তো নে’লে, আর দে’লে না।
জীবনটা ওইরকম। মাঝে-মাঝে সব নিয়ে নেয়। আর কিছু দেয় না।
সেবক স্টেশনের কাছে লেভেল ক্রসিং পার হয়ে জিপ উঠে এল কালিম্পঙের পাহাড়ি রাস্তায়। দূরে দুই পাহাড়ের কোলে করোনেশন ব্রিজের আর্চ দেখা যাচ্ছে। নীচে তিস্তা। শরতের নদীটা এখনও বর্ষার ঢল নিয়ে নেমে যাচ্ছে। সাদা, সফেন জল, সেই জলের প্রবল শব্দ। তিস্তার দু’ধারে বালির বিছানা। বাঁ পাশের তীর ধরে ছিল রেল লাইন। ছছাট্ট ছোট্ট সব স্টেশন। নিরিবিলি, নিঝুম। এখন আর কিছু নেই। স্টেশনের ঘরগুলো পর্যন্ত না। দিগিন ঝুঁকে দেখতে লাগলেন।
বে-খেয়ালে গরমজামা আনেননি। হঠাৎ চলে এসেছেন খেয়ালখুশিমতো। রমণীমোহন আর কপিলেরও গরম জামা নেই। শরৎকাল। পাহাড়ে এ সময়ে শীত পড়ে যায়। কিন্তু রমণীমোহন বা কপিল তার জন্য দিগিনকে কিছু বলবে না। দিগিনকে তারা জানে। কখনও তার কোনও কাজে তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত ঢোকায়নি।
.
এখন আর কিছু করার নেই। দিগিন তবু বললেন, কপিল, গরমজামা আনার কথা খেয়াল হয়নি রে। তোদের কষ্ট হবে।
রমণীমোহন স্থির চোখে চেয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, কালিম্পং যাবেন তো?
তাই তো যাচ্ছি।
দুপুর দুপুর কাজ সারতে পারলে ফিরে আসতে কষ্ট হবে না। রোদ থাকবে ততক্ষণ। বেলা পড়ে গেলে ঠান্ডা লাগবে।
কাজ। কাজের কথা খেয়াল ছিল না। মনেও পড়ল না। চার ধারে চেনা পাহাড়, বনস্থলী, নদী, কত পুরনো স্মৃতির ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে চারধারে। সম্মােহিত দিগিন জানেন, এই হল কাজ। সেই পুরনো রেল লাইন খুঁজতে খুঁজতে, সেই পুরনো স্টেশনের চিহ্ন ধরে ধরে আবার অতীতে ফিরে যাওয়া, যেখানে আজও এক অলীক স্টেশনে দুমুঠো ধুলো হাতে করে মুগ্ধ এক শিশু দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছু কাজ নেই।
ডাকলেন, কপিল।
আজ্ঞে।
ঠিকাদারের চৌকিদারি তোর কাজ নয়। তোর আসল কাজ কী কপিল?
কপিল চুপ করে থাকে।