খুব মাঝরাত তখন। প্রণতি অবশেষে শুয়েছে। দিগিনের ঘুম এল না। একেবারে প্রথম রাতে না। ঘুমোলে তার ঘুম কেটে যায়। শুয়ে থেকে কাহাতক আর সময় কাটাবেন। সে আমলের ক্যাভেন্ডার সিগারেট একটা বের করে ধরিয়ে শুয়ে শুয়ে টানছেন। সব জানালা বন্ধ। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। কেবল দরজায় কাচ ফেলা বলে একটু ঘষা আলো দেখা যাচ্ছে। চাঁদের মুখে মেঘ জমেছে নিশ্চয়। ট্রেনটা থেমে আছে কোথাও সিগনাল না পেয়ে। বাইরে জলা-জমি থেকে ব্যাঙের ডাক আসছে। তখন পৃথিবীতে মানুষ কম ছিল, নির্জনতা ছিল, ট্রেন যেত বিজনের ভিতর দিয়ে। অনেক দূর পর্যন্ত লোকবসতি ছিল না উত্তরবাংলায়। ভুতুড়ে মাঠে ঘাটে অলৌকিক জ্যোৎস্না খেলা করত। জিন ছিল, পরি ছিল।
সেই খুব আবছা অন্ধকার থেকে একটা অশরীরী স্বর এল, ক’টা বাজে?
দিগিন প্রথমটায় চমকে উঠলেন। এত ক্ষীণ স্বর যে প্রথমটায় বুঝতে পারলেন না ভুল শুনেছেন। কি না। তারপর বুঝলেন প্রণতি।
খুব সন্তর্পণে সিগারেটের আলোয় ঘড়ি দেখে বললেন, একটা।
তারপর সব চুপ।
খুব সাহস করে দিগিন আস্তে বাতাসে কথা ক’টা ছাড়লেন, তুমি ঘুমোওনি?
না। ঘুম আসছে না।—যেন কথা নয়, বাতাসের শব্দ, এত ক্ষীণ আব নরম গলা।
আমিও না।—দিগিন ঝুঁকে বললেন। তারপর আবার একটু চুপ করে থেকে বুকের কাপুনিটা সামলালেন। বললেন, তুমি কিছু খেলে না।
আমার খিদে পায় না।
কেন?
এমনিই।
এত আস্তে কথা হচ্ছিল যে পরস্পরও শোনবার কথা নয়। সে যেন দুর থেকে কানে কানে বলা। তবু কী আশ্চর্য তারা শুনতে পাচ্ছিলেন। ভালবাসা বুঝি এমনিই। ইন্দ্রিয়ের শক্তি বাড়িয়ে দেয়।
কলকাতায় ক’দিন থাকবে?
বেশি দিন না।
বেড়াতে যাচ্ছ?
হুঁ। মামার বাড়ি।
আমি সাত দিন পরে ফিরব। তোমরা?
এক মাস।
আর কি তেমন কোনও কথা হয়েছিল? ঠিকঠাক আজ আর মনে পড়ে না। তবে হলেও এর চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ কিছু নয়।
সকালে দিগিন ঘুমহীন রাত-শেষে উঠলেন। আবার জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে প্রণতি। ফিরে তাকায় না।
বড্ড জ্বালিয়েছিল সেবার মেয়েটা। বুকে এমন একটা ঢেউ তুলে দিয়েছিল, দিগিনকে প্রায় গহিন সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই ঢেউ। তখনও প্রণতি কিশোরী মাত্র।
তখন প্রেম এটুকুই মাত্র ছিল। তবু এটুকুও কম নয়।
কপাল। সেবার কলকাতা গিয়ে এক মাসের নাম করে বহুকাল থেকে গেল প্রণতিরা। শিলিগুড়িতে ভাল ইস্কুল ছিল না, কলেজ তখনও হয়নি। মামারা বড়লোক। তারা ভাগনে-ভাগনিদের সেখানেই রেখে দিল। বহুকাল ওরা আর আসেনি। চৌধুরীগিন্নি অবশ্য এসে থাকতেন প্রায়ই।
প্রেমটা কেটে যাচ্ছিল কি! কে জানে। ঘটনাটা কেন আজও অত হুবহু মনে আছে?
কয়েক বছর বাদে ভারত সরকার আর পূর্বপাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি হয়। সেই তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন সালের কথা, চুক্তি হল ভারতের মালপত্র নিয়ে ব্রডগেজের গাড়ি পূর্বপাকিস্তানের ভিতর দিয়ে আসবে, তাতে দূরত্ব কমবে, সময় বাঁচবে। তখন এ অঞ্চলে ব্রডগেজ লাইন উঠে গিয়ে মিটারগেজ হয়ে গেছে। তাই ঠিক হল পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে ব্রডগেজের গাড়ি হলদিবাড়ি পর্যন্ত আসবে। সেখানে ট্রান্সশিপমেন্ট হয়ে মিটারগেজে উঠে চালান হবে উত্তরবাংলায় আর আসামে। এই চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হলদিবাড়ি স্টেশনের দাম বেড়ে গেল রাতারাতি, সবাই হলদিবাড়িতে পোস্টিং চায়। ট্রান্সশিপমেন্ট মানেই টাকা, আর হলদিবাড়িতে যে বিপুল মাল এ-গাড়ি থেকে ও-গাড়িতে উঠবে তাতে বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা খেলা করবে। স্টেশন-মাস্টাররা ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য রেলওয়ের কাছ থেকে চুক্তিমতো টাকা পায়, আর কুলির সর্দারদের সঙ্গে তারা আর-এক রকম চুক্তি করে নেয়। এই দুই চুক্তির মধ্যে ফারাক থাকে অনেক। ফলে ভাল স্টেশনের মাস্টারদের ঘরে লক্ষ্মী কঁপি উপুড় করে দেন।
হলদিবাড়ির খবর হতেই চারদিকে স্টেশন মাস্টাররা আনচান করে উঠলেন। দৌড়োদৌড়ি শুরু হল, অফিসারদের বাংলোয় ভেটের ছড়াছড়ি হতে লাগল। শিলিগুড়ির এ-টি-এস সাহেব তখন বাঙালি, সজ্জন লোক, ঘুষটুষ খেতেন না। মদন চৌধুরী তার মাকে মা ডেকে, সপরিবারে নেমন্তন্ন খাইয়ে এমন আত্মীয়তা গড়ে তোলেন যে সাহেব মদন চৌধুরীকে পোস্টিং দিয়ে দিলেন।
একমাসে মদন চৌধুরীর চেহারা এবং স্বভাব পালটে গেল, একটা ওপেন ডেলিভারি নিতে। হলদিবাড়ি গিয়েছিলেন দিগিন। দেখেন চৌধুরীর মুখে-চোখে একটা উদভ্রান্ত ভাব, চেহারার সেই স্নিগ্ধতা নেই, দিনরাত স্টেশনে পড়ে থাকেন। চোখদুটো চকচকে, সবসময়ে চতুর্দিকে ঘুরছে। দিগিনকে দেখে বললেন, চাটুজ্জে, আপনার তো অনেক জানাশুনো, জলপাইগুড়ি কমিশনার সাহেবকে বলে আমাকে একটা রিভলভারের লাইসেন্স বের করে দিন।
দিগিন অবাক হয়ে বলেন, রিভলভার দিয়ে কী হবে?
চৌধুরী তেমনি উদভ্রান্তভাবে অসংলগ্ন কথা বলেন, এত টাকা, কখন কী হয়!
চৌধুরীর বাড়ির চেহারাও পালটেছে, বড় ছেলে বাদে আর ছেলেমেয়েরা স্থায়িভাবে কলকাতায় থাকে। বেশিরভাগ জিনিসপত্রও কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছেন চৌধুরী, স্ত্রীও গেছেন। সেখানে চৌধুরীর বাড়ি হচ্ছে, দুটো বাড়ি একটা বউয়ের নামে, অন্যটা বিধবা বোনের নামে। রেলের কোয়ার্টারে দুটো ঘর। ভিতরের ঘরটা সবসময় তালাবন্ধ, বাইরের ঘরটায় দুটো ক্যাম্পখাটে বাপ-ব্যাটা শোয়। ঝি-চাকর কাউকে রাখেনি। ছেলেই বান্না করে।