একবার কলকাতা যাবেন। চৌধুরী এসে বললেন, আমার বাড়ির ওরাও যাবে। আমি বলি কি আপনার সঙ্গে চলে যাক।
কে কে যাবে তা জিজ্ঞেস করলেন না দিগিন। কিন্তু উচাটন হয়ে রইলেন। প্রণতি যাবে।
যাওয়ার দিন স্টেশনে গিয়ে দেখেন প্লেস করা গাড়ির একটা ইন্টার ক্লাস কামরায় চৌধুরীব দুই মেয়ে, বউ, আর ছেলে বসে আছে। বুকখানা নড়ে উঠল দিগিনের। ভিড়ের গাড়ি নয়। তখন অফ সিজিন চলছে। ফঁকা কামরাটায় তারা মাত্র ক’জন। সে যে বয়ঃসন্ধির আশা-নিরাশার কী গভীর উদ্বেগের দিন গেছে সব। নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে মনে হয়, কখনও মনে হয় সবচেয়ে আহাম্মক বোকা। তখন গেরস্ত ঘরের মেয়েরা সহজলভ্যা ছিল না। তাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে বুকের পাটা লাগত।
প্রণতি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বসে রইল তো রইলই। চৌধুরীর বউ আর ছেলে দিগিনকে খুব খাতির করতে থাকে। চৌধুরীগিন্নি টিফিন ক্যারিয়ার খুলে অনেক খাবার খাওয়াল, পান খাওয়াল। বাড়ি-ঘরের খোঁজখবব নিল। দিগিন আড়চোখে প্রণতিকে দেখে নিয়ে কিছু বাড়িয়েই বললেন। বয়সের মেয়ের সামনে দু’বটে গুলচাল না ঝাড়ে কে!
রাতের গাড়ি। ছাড়তে-না-ছাড়তেই ঢুলুনি পেয়ে গেল সবার। খাওয়ার পর একে একে সবাই শুয়ে পড়ছে। দিগিন বাঙ্কে শুয়ে একটা বাসি প্রবাসী খুলে পড়বার চেষ্টা করছে। আসলে সেটা ভান। প্রথমত দিগিন বই-টই পড়তে ভালবাসেন না। দ্বিতীয়ত গাড়ির ঝাকুনিতে পড়া যাচ্ছিলও না।
চৌধুরীগিন্নি আর ছেলে একটা সিটে দু’ধারে মাথা রেখে শুলেন। অন্যটায় নমিতা আর প্রণতি। নমিতা শুল, কিন্তু প্রণতি ঠায় বসে রইল।
তার মা ডাকে, ও প্রণতি শুবি না!
সে মাথা নাড়ে। শোবে না।
কেন?
ঘুম আসছে না। বিরক্ত হয়ে প্রণতি বলে।
জামদানি শাড়ি পরা নিশ্চল মূর্তি বসেই রইল। একবারও মুখ ফেরাল না ভিতরবাগে। সবাই যখন খাচ্ছিল তখনও ওইভাবে ছিল। খায়নি! তার নাকি খিদে নেই। দিগিন বুঝতে পারছিলেন, তিনি কামরায় আছেন বলেই মেয়েটার ওই কাঠ কাঠ ভাব। তবে কি মেয়েটা তাকে অপছন্দ করছে? দিগিন কি বিশ্রী দেখতে? মেয়েটা কি রোগা মানুষ পছন্দ করে? না কি দিগিনের গুলচালগুলো সব ধরে ফেলেছে মেয়েটা। বরাবরই কি দিগিনের প্রতি ঘৃণা পুষে এসেছে মনে মনে?
খুবই তুচ্ছ কিন্তু জরুরি প্রশ্ন সব।
অন্য বাঙ্কে শেষ সময়ে এক বুড়ো পশ্চিমা উঠে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নাকের ডাক শোনা যাচ্ছিল। ক্রমে সকলেই গভীর বা হালকা ঘুমে ঢলে পড়ছিল, চৌধুরীগিন্নি ঘুমগলায় এক বার বললেন, জানালাটা বন্ধ করে বোস, ঠান্ডা লাগবে।
না। আমার মাথা ধরেছে।
গলার হার-টার যদি কেউ টেনে নেয়। দেখিস।
উঃ, তুমি ঘুমোও না।
কিছু তো খেলি না।বলে চৌধুরীগিন্নি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
দিগিনের মাথা তখন আগুন। ওই রোগা একরত্তি মেয়েটার অত দেমাক কীসের? না হয় দিগিন তেমন লেখাপড়া জানেন না, না হয় একটু জংলা চেহারা, তাই কি? পুরুষ, আস্ত একটা জলজ্যান্ত পুরুষ কাছে থাকলে একবার ফিরে তাকাতে নেই?
ধৈর্য ধরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন দিগিন। না। অবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই। শুধুমাত্র শরতের ঠান্ডা থেকে গলা বাঁচানোর জন্য আঁচলটা জড়িয়ে নিয়েছে গলায়। আর, বোধ হয় একটু হেলে বসেছে জানালার কাঠে ভর দিয়ে।
উপেক্ষা কোনও দিনই সহ্য করতে পারেন না দিগিন। অনেক ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করলেন। কামরার আলোগুলি ধু-ধু করে জ্বলছিল। দিগিন হঠাৎ ঝুঁকে বললেন, আললাগুলো নিভিয়ে দেব? সবাই ঘুমোচ্ছে তো, আললা থাকলে অসুবিধে।
মেয়েটা শুনল কি না বোঝা গেল না। বসেই রইল।
শুনছেন!—দিগিন ডাকেন।
মেয়েটা একটু নড়ল, বা কাঁপল।
ক্ষীণ গলায় উত্তর এল, দিন।
আপনার অসুবিধে হবে না তো?
মেয়েটা ফেরানো মাথাটাই নাড়ল একটু। ঘাড় ফেরাল না।
দিগিন শব্দসাড়া করে বাথরুম সেরে এসে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।
কী অদ্ভুত দৃশ্য তখন! সেদিন পূর্ণিমা ছিল বোধ হয়। কী জ্যোৎস্নার আলো এসে ভরে দিল কামরা! আর সেই জ্যোৎস্নায় মাখা কালো পরির মতো, রূপসি জিনের মতো জানালায় বসে আছে প্রণতি।
ঘুম কি হয় দিগিনের! কামস্পৃহা নয়। নারীপ্রেমও নয়। সে এক অলৌকিকের অনুভূতি। জীবনের সব চাওয়া যেন ওই মূর্তিটায় গিয়ে জমাট বেঁধেছে। কী জ্যোৎস্না! আর কী প্রস্তরীভূত সেই দেহখানি!
সজাগ দিগিন আর চোখ ফেরাতে পারেন না।পাশ ফিরে চেয়ে রইলেন।
অনেক অনেকক্ষণ বাদে মেয়েটার বুঝি মনে হল যে এবার সবাই ঘুমিয়েছে। চকিতে একবার চাইল ভিতরের দিকে। সবার আগে তাকাল দিগিনের দিকে। সে দিগিনের মুখ দেখতে পাবে না জেনেও দিগিন চোখ বুজে নিথর হয়ে ঘুমের ভান করলেন।
মেয়েটা উঠল। বাথরুমের দিকে গেল পথ হাতড়ে।
খুটখাট একটু শব্দ হল বুঝি। বাথরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
কী সতর্ক মায়েদের মন! ওই যে একটু খুটখাট শব্দ হল তাইতেই চৌধুরীগিন্নি উঠে বসলেন। প্রণতির শূন্য আসন দেখলেন। বাথরুমের দরজার ঘষা কাচে আলো দেখলেন। সন্দেহ হল। চকিতে একবার মুখ উঁচু করে দেখে নিলেন, দিগিন তার জায়গায় আছেন কি না।
দিগিন মনে মনে হাসেন আজও। কত কুট হয় মানুষের মন! কত সন্দেহ আসে!
বাথরুম থেকে এসে আর কাঠ হয়ে থাকল না প্রণতি। সহজ হয়ে বসল। চুলটা ঠিক করল খানিক, বেণির শেষ মাথায় রিবনের ফঁাস খুলে গিয়েছিল, সেটা বাঁধল। জলের বোতল থেকে জল খেল। এবং বারংবার তাকাল দিগিনের অন্ধকার বাক্তের দিকে। দিগিন মনে মনে হাসলেন।