দিগিন বললেন, চালসায় তোর কী কাজ ছিল?
কিছু না। একটা কালভার্ট হয়েছিল, সেটা ভেঙে পড়েছে প্রথম লরিটা পাস করতেই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ডেকে শানুবাবুকে গরম খেয়েছেন। সেইটে ফের করে দিতে হচ্ছে, নইলে কেস করবে গভর্নমেন্ট। সেই কাজ সত্যেনবাবু দেখছেন, আমি গিয়ে ভেরেন্ডা ভেজে এলাম।
ভিতরে ভিতরে আগুন হয়ে যায় দিগিন। সোপস্টোন মায়ামৃগের মতো মিলিয়ে গেছে, ঠিকাদারিও যাবে। চ্যাটার্জি কনস্ট্রাকশনের যে সুনাম আছে তা উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যাবে শানু। একটা কালভার্ট করতে গিয়েও বেশি লাভ খাবে, প্রথম লরিটাও নিরাপদে পেরোতে পারবে না। আবার তৈরি করতে ডবল গচ্চা যাচ্ছে। শানু আজকাল কিছু খুলে বলে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ব্যাবসাটার মধ্যে উইয়ের মত গর্ত খুঁড়ে ঝুরঝুর করে দিচ্ছে।
দিগিন মিস্তিরিকে ডেকে বললেন, কতক্ষণ লাগাবি?
আপনি কাজ থাকলে চলে যান না। পিন আনতে লোক পাঠিয়েছি, ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দেব’খন।
দিগিন চিন্তিতভাবে জিপে উঠলেন, রমণীমোহন গাড়ি ছাড়ল, মুখটা ঘুরিয়ে নিল জেলখানার দিকে। পিছনের সিটে বসা কপিল একটু কেশে বলল, ঢালাইয়ের দিন মিস্তিরিদের ভরপেট মিষ্টি খাওয়ানোর নিয়ম, সেটা শানুবাবু তুলে দিয়েছেন। বললে বলেন, রোজ ঢালাইয়ের কাজ হবে আর রোজ মিষ্টি খাওয়াতে হবে এ নিয়ম চলবে না।
দিগিন গম্ভীর গলায় বললেন, হুঁ।
চুপ করে রইলেন। শানুর ওপর কেউ খুশি নয়। সবাই যেন পাকে-প্রকারে, নানা আকারে-ইঙ্গিতে বলতে চাইছে, শানুকে সরিয়ে দিয়ে এবার দিগিন হাল ধরুন। দিগিনের আজকাল আর ইচ্ছে করে না।
নতুন জেলখানা পুরনো বাজার ছাড়িয়ে, জলপাইগুড়ির বাস যেখানে দাঁড়ায় তারও খানিকটা পশ্চিমে। গাড়িটা জেলখানায় ঢুকতেই দুর থেকে দেখেন, শানু কালো চশমা চোখে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নেপাল থেকে চোরাপথে আনাননা বিদেশি স্ট্রেচ প্যান্ট, গায়ে একটা মার্কিন ব্যানলনের গেঞ্জি। নীল প্যান্ট, আর হালকা হলুদ গেঞ্জিতে ভাল দেখাচ্ছে। বেশ লম্বাটে, সাহেবি ধরনের চেহারা, কলকাতায় লেখাপড়া শিখতে গিয়েছিল, তখন এক বার সিনেমাতেও নেমেছিল। সেই থেকে শিলিগুড়িতে ওকে সবাই গুরু বলে ডাকে।
জিপ থামতেই শানু দৌড়ে এল।
কাকা, জলঢাকা যাওয়া হয়নি। ঝামেলা পাকিয়ে গেল।
দিগিন তাকালেন। বললেন, কত টাকার মাল গেছে?
তিন-চার হাজার টাকার তো বটেই। ছোট কাজ ছিল, বেশি মার্জিন থাকত না।
দিগিন মাথা নেড়ে বললেন, শাটারিং-এর কাঠ আনতে লোক পাঠিয়েছ?
শানু একটু যেন অবাক হয়ে বলে, না, এখনি আবার শাটারিং-এর কাঠ কিনব কেন? যত দূর মনে হচ্ছে পুলিশের লোকই সরিয়েছে। কিছু সি-আর পি আছে। বড্ড পাজি। দেখি যদি বের করতে পারি।
দিগিন বিরক্ত হয়ে বলেন, সে তুমি দেখোগে। তা বলে ঢালাইয়ের কাজ তো বন্ধ রাখা যাবে না। কাঠ কিনতে লোক পাঠাও, আর গোডাউনে কিছু রড আছে, আনিয়ে নাও।
শানু তেমনি বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, সময় তো আছে, এত তাড়ার কিছু নেই। আর সাত দিন দেরি করলেও কিছু হবে না। তা ছাড়া মিস্তিরিরা আজই শাটারিং করে ঢালাই করতে কি পারবে?
দিগিন গম্ভীর হয়ে বললেন, পারতেই হবে। মিস্তিরিদের ডাকো। আমি কথা বলে যাব, তুমি একটা জিপ ভাড়া করে জলঢাকা চলে যাও আজই।
হেডমিস্ত্রি দিগিনের হাতের লোক। সে এসে দিগিন কিছু বলার আগেই বলল, আজই ঢালাই করে দেব। আপনি যান।
জিপ থেকে দিগিন আর নামলেন না, জিপ ছাড়তে ইঙ্গিত করলেন রমণীমোহনকে। এক বার চেয়ে দেখলেন, শানুর মুখ খুব গম্ভীর, প্রেস্টিজে লেগেছে বোধ হয়। কর্মচারীদের সামনে দিগিন ওকে পাত্তা দিলেন না তেমন। তার ওপর জলঢাকা যেতে হচ্ছে।
রমণীমোহন জিপ ছাড়ল। কপিল দৌড়ে এল জিপের সঙ্গে, কী যেন বলবার জন্যে মুখটা উন্মুখ, দিগিন চোখের ইশারা করলেন, কপিল জিপের পিছনে উঠে পড়ল।
বাসার দিকেই মুখ ঘোরাল জিপ। দিগিন চুপ করে বসে ছিলেন। হঠাৎ বললেন, কপিল।
আজ্ঞে।
শালখুঁটিগুলো কাকে বেচেছিস?
একটু চুপ করে থেকে কপিল বলল, অনাদিবাবুর গোলায়।
কখন?
ভোর রাতে। একটা সাপ্লাইয়ের লরি এসেছিল, তাদের ভজিয়ে মাল তুলে দিয়েছি।
কততে বেচলি?
বিনা দ্বিধায় এবং সম্পূর্ণ অকপটে কপিল বলল, শানুবাবুর কথা ধরবেন না। তিন-চার হাজার টাকার মাল ছিল না। মেরে কেটে হাজারখানেকের মতো হবে। আমি তিনশো পেয়েছি।
দিগিন একটু হাসলেন। কপিলকে তিনি চেনেন, এমন প্রতিশোধস্পৃহা খুব কম লোকেরই থাকে, প্রতিশোধ নেয়ও খুব কুটকৌশলে।
পিছন থেকে কপিলের হাতটা এগিয়ে এল। তাতে একশো টাকার তিনটে নোট, ভাজকরা, দিগিন নিয়ে বুক পকেটে রাখলেন। রমণীমোহনকে বললেন, সেবক রোড ধরে চলো।
বিনা উত্তরে নিউ মার্কেটের রাস্তা ধরে সেবক রোডে গাড়ি উঠিয়ে আনল রমণীমোহন, পিছনে কপিল চুপ করে বসে আছে। সে লজ্জিতও নয়, দুঃখিতও নয়, নির্বিকার। মল্লিকা মরে যাবার পর থেকেই ও রকম। ওর ভালবাসার, স্নেহের কোনও কেন্দ্রবিন্দু নেই। এখনও অবসর সময়ে কীর্তন করে। কীর্তন করতে করতে যদি কৃষ্ণভক্তি আসে কখনও, তো ভাল, না এলে একদিন বুড়ো হয়ে এমনিই মরে যাবে। কেউ কঁাদার নেই।
.
টাকা—এই কথাটা আবার মনে পড়ল। টাকা।
টাউন স্টেশনের স্টেশনমাস্টার ছিলেন মদন চৌধুরী। তেল চুকচুকে শরীরখানি। মুখভাব আহ্বাদে ভরা, পান খেতেন, বিলোতেন। স্টেশনমাস্টার হিসেবে খারাপ ছিলেন না, মানুষটাও ভাল। তার দুই মেয়ে ছিল, নমিতা আর প্রণতি। প্রণতি ছোট, দীঘল কালো চেহারা, কিন্তু কালো রঙে অমন রূপবতী সে-আমলে দেখেননি দিগিন। ভারী লোভ হত। দিগিনের বয়স তখন কিছু না। ওদের বাড়িতে যেতেন-টেতেন। প্রণতি অবশ্য খুব একটা সামনে আসত না। তবু পাশের ঘরে তার পায়ের শব্দ, গলার আওয়াজ শুনতেন। পরদার ফঁক-ফোকর দিয়ে দেখা যেত। মদন চৌধুরীরা বারেন্দ্ৰশ্রেণি, আর সে সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। প্রায়ই বলতেন, ভাল দুটো বারেন্দ্ৰশ্রেণির পাত্র খুঁজবেন তো। চাটুজ্জে। এ সব পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ সালের কথা। তখনও ময়নাকে আনেননি দিগিন।