লোকটা উঠে গিয়ে ভিতরের ঘরের নোংরা পরদাটা কেবল তুলে যোবা হয়ে রইল। এক হাতে পরদা ধরা, অন্য হাতটা বাড়ানো। সেই বাড়ানো হাতে দিগিন টাকার নোটগুলো গুঁজে দিলেন।
ভিতরের খুপরিতে লণ্ঠন জ্বালা আলোয় ছিপকির দিকে তাকিয়ে তার প্রথম যে কথাটা মনে হল, এ হচ্ছে কপিলের মেয়েছেলে। চোর, হাভাতে ঘোটলোক কপিল।
দিগিন বিছানায় বসেছিলেন, গা ঘেঁষে ছিপকি, কাধে হাত। মুখে অদ্ভুত উত্তেজিত হাসি! সে জানে তার বাজার ভাল। কিন্তু এতটা ভাল তা সে কল্পনা করেনি। সে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দিগিনের মুখের ওপরেই শ্বাস ফেলল। নিজের গালে আঙুল বুলিয়ে বলল, এ সব কিন্তু গরমি নয়। ব্রণ। আমি খারাপ লোকের সঙ্গে দোস্তি করি না।
দিগিন ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে চুরুট টানছিলেন। মেয়েটা ঘাড়ের ওপর হামলে পড়ে আছে। পঞ্চাশ টাকায় কেনা মেয়েছেলে, যা খুশি করতে পারেন। তবু এই মেয়েটা কপিলের এঁটো, কিংবা কপিলই এই মেয়েটার উচ্ছিষ্ট?
মেয়েটাকে এক ঝটকায় টেনে সামনে দাঁড় করালেন দিগিন। লণ্ঠনের আলোয় চেয়ে রইলেন ওর দিকে। শরীরে সীমাবদ্ধ মেয়েমানুষ। নদীর মতো, সবাই স্নান করে যায়। গহিন চুলের মস্ত খোঁপা, রোগা চেহারা, সর্বশরীরে চামড়ার ওপর খসখসে ভাব। গলার চামড়ার ভাজে ময়লা বা পাউডার জমে আছে।
নেপালিতে বললেন, ও লোকটা তোর কে হয়?
মেয়েটা লাজুক হেসে বলল, সঙ্গে থাকে।
স্বামী?
ছিপকি মুখ ভ্যাঙাল।
দেখি তোর হাত।-বলে দিগিন ওর হাত টেনে নিবিষ্ট মনে ওর হস্তরেখা দেখলেন। ভ্রু কুঁচকে, কপালে ভাঁজ ফেলে অনেকক্ষণ ধরে দেখে-টেখে বললেন, দূর! তুই এখানে পড়ে আছিস কেন? তোর ভাগ্য তো খুব ভাল। এখন বয়স কত?
মেয়েটা হিসেব জানে না। অবাক হয়ে বলল, কত জানি না।
দিগিন বললেন, বাইশ-তেইশ হবে। আর এক বছরের মধ্যে তোর ভাগ্য ফিরে যাবে।
সকলেরই এই দুর্বলতা থাকে, ভাগ্য বিষয়ক। মেয়েটা মাতাল দিগিনকে সঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, মাতালরা কত কাণ্ড করে। তবু হাতটা চেপে ধরে বলল, কী হবে?
তোর বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, সব লেখা আছে। এ লোকটার সঙ্গে পড়ে আছিস কেন? পালা।
এই বলে দিগিন উঠে পড়লেন। দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, তোর সঙ্গে সময় কাটাতে এসেছিলাম, কিন্তু ভয় পেয়ে গেলাম রে। তুই একদিন খুব বড় হবি তো, তাই ভয় লাগল।
দিগিন বিদায় নেওয়ার আগে আরও পঞ্চাশটা টাকা ছিপকির হাতে গোপনে দিয়ে বললেন, তোর স্বামী তোর কষ্টের টাকা সব মেরে দেয় জানি। এটা রাখ। জানি তুই যখন বড় হবি তখন এ সব দশ-বিশ-পঞ্চাশ টাকা ভিখিরিকে দিয়ে দিবি। ভাল চাস তো কালই পালিয়ে যা!
কোথায় যাব?
কোথায় যাবি!
দিগিন একটু ভাববার ভান করেন। শেষে আবার দশটা টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলেন, শালবাড়িতে চ্যাটার্জির কাঠগোলায় চলে যাস। শনিবার-মঙ্গলবার থাকি। কলকাতায় পাঠিয়ে দেব। ফিলমে নামবি? আমার দোস্ত আছে।
হিপকির চোখ-মুখ কী রকম যেন উজ্জ্বল হয়েছিল ফিলমের নামে! অনেকখানি ঘাড় হেলাল, আর ছুটে এসে বুকে পড়ে একটু আদর করেছিল দিগিনকে।
মেয়েটা বোধ হয় পালিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করেছিল। কয়েকদিন পর তার শরীরটা এক সকালে পাওয়া গেল মহানন্দার বিশুষ্ক নদীর খাতে। একটু একটু জল চুইয়ে বয়ে যাচ্ছে নালার মতো শীতের পাহাড়ে নদী। তারই জল ছুয়ে একবুক রক্ত ঢেলেছে ছিপকি। কুকরিতে পেটটা হাঁ হয়ে আছে।
৪. লোকটা ধরা পড়ল
লোকটা এক মাস পরে ধরা পড়ল মাদারিহাটে। দোকানটা তার আগেই উঠে গেছে।
তখন এ রকম মহানন্দার পাড়ে হামেশা লাশ পাওয়া যেত। চাটাইয়ে বেঁধে ধাঙড়রা নিয়ে আসত হাসপাতাল মর্গে। দু-চার ঘা ছুরি চালিয়ে ডাক্তাররা রিপোর্ট দিত। ধাওড়রা ফের চাটাই বাঁধা মড়া নিয়ে হয় পোড়াত, নয়তো পুঁতত। ছিপকির জন্য এখনও একটা কষ্ট হয় দিগিনের। পালাতে গেলেই যে খুন হবে, সেটা ভেবে দেখেননি দিগিন। চালের ভুল। তা হোক, তবু দোকানটা ওঠানো গেছে। কপিল কিছুদিন মনমরা হয়ে ছিল।
এখন কপিলকে দেখে একটু ভ্রু কোঁচকালেন দিগিন। রূঢ় মুখভাব করে একটু চেয়ে রইলেন। কর্মচারীদের সঙ্গে তার ব্যবহার একটু কর্কশ। মুখভাবে তিনি কাউকেই প্রশ্রয় দেন না।
কপিল কখনও দিগিনের চোখে তাকায় না। নানা পাপ জমে আছে ভিতরে। তাকাতে পারে না। একবার মুখের দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। কাল রাতে শাটারিং-এর কাঠ কারা খুলে নিয়ে গেছে। আজ ঢালাই হওয়ার কথা।
দিগিন অবাক হন। বলেন, জেলখানার ঢালাইয়ের?
কপিল মাথা নাড়ল, কয়েকটা শালখুটিও উপড়ে নিয়েছে। লোহার রডও।
দিগিন একটা বিরক্তির শব্দ করে বললেন, চৌকিদার কে ছিল?
কেউ ছিল না। শানুবাবু তিন দিন আগে আমাকে জেলখানার ক্যাম্প থেকে সরিয়ে চালসার রোড কনস্ট্রাকশনের কাছে পাঠিয়ে দেন। বলেছিলেন, জেলখানার কাজ, মালপত্র পুলিশেরাই দেখতে পারবে। তবে দাজুকে শানুবাবু দেখতে বলেছিল, সে কাল থেকে মাল খেয়ে কোথায় পড়ে আছে।
দিগিন শানুর বুদ্ধি দেখে অবাক হন। চৌকিদার হিসেবে কপিল ভাল নয় ঠিকই, মাল কিছু সরাবেই। কিন্তু কপিল কখনও কাজ নষ্ট করবে না। তাকে সরিয়ে দাজুর ভরসায় এত মালপত্র ফেলে রাখতে কে ওকে বলেছিল? দাজু কোনওকালে সন্ধের পর স্বাভাবিক থাকে না।