শানু রেগে গিয়ে বলে, কিন্তু ভুটান গভর্নমেন্ট অত টাকা চাইবে কেন? ডিপোজিটটার খোঁজও ততা ওরা রাখে না, আমরা খুঁজে পেয়েছি। সুতরাং রাইট তো আমাদের। ওদের উচিত নমিনাল একটা টাকা নিয়ে খনিটা ছেড়ে দেওয়া।
দিগিন হাসলেন। বললেন, তা তো দেবেই না, বরং ওরা তোমাদের হটিয়ে নিজেরাই সোপস্টোনটা তুলে ব্যাবসা করবে।
কিন্তু আমরা যে ওটা খুঁজতে বিস্তর টাকা ঢাললাম, সেটা কে দেবে? ওরা দেবে?
খোঁজার সময়ে তো ওদের পরামর্শ নাওনি। ঘরের টাকা ঢেলে বরং ওদের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছ। ওরা দেবে কেন?
কিন্তু দেওয়া তো উচিত।
ওদের সেটা বোঝাও গিয়ে।
শানু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলে, আমি লাভ চাইছি না। খরচটাও যদি উঠে আসত।
উঠবে না। বরং আরও টাকা বেরিয়ে যাবে। কোথায় কোন জয়ন্তীয়ায় নদীর ধারে একটা সোপস্টোনের টুকরো খুঁজে পেয়ে কে একজন এসে তোমাকে খবর দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে গুপ্তধন পাওয়ার মতো নেচে উঠলে। দুনিয়ায় যদি এত সহজেই সব পাওয়া যেত।
কাঠের মেঝেয় শানু পায়চারি করতে থাকে। দিগিন চোখ দুটো অল্প একটু খুলে ভাইপোকে দেখেন। বংশটাতেই পাগলের বীজ আছে। জয়ন্তীয়ায় নদীর ধারে সোপস্টোনটা খুঁজে পেয়েছিল শান্তি পাল নামে একজন ভবঘুরে। সে কেমন করে শানুকে বশ করে বুঝিয়েছিল, কাছেপিঠেই সোপস্টোনের মস্ত কোনও খনি আছে। শানুও নিশ্চিত হয়ে লোকটাকে খোঁজার কাজে লাগায়। লোকটা দিনে বারো টাকা নিত, সঙ্গে আরও তিন জন হা-ঘরেকে জুটিয়ে নিল, তারা পেত দিনে আট টাকা। এ ছাড়া ছিল আনুষঙ্গিক খরচ-খরচা, ত্রিশ হাজারের বেশিই বেরিয়ে গেছে। পায়ের পাতায় আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢাকা দেন দিগিন। চোখ বোজেন এবং উভয়পক্ষের একটি করে গোল দেওয়ার বিষয়টা ভাবতে থাকেন।
শানু আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধৈর্যহীন, চঞ্চল, ক্ষুব্ধ।
ছোটকাকা।
হু।
অনেক লস হয়ে গেল।
বুঝতে তো পারছি।
বুঝতে পেরে চুপচাপ বসে আছ কী করে?
কী করব?
কিছু একটা করা তো দরকার।
দু’বছর ধরে চারটে লোকের কর্মসংস্থান করেছ, এ তো ভালই। তোমার লাভ যদি লবডঙ্কাও হয়, তবু ওই চারটি লোকের অনেক আশীর্বাদ তোমার পক্ষে জমা হয়েছে। সেইটাই স্যাটিসফ্যাকশন।
শানু কোমরে হাত দিয়ে ঋজু দাঁড়িয়ে তার অকৃতদার, বিচক্ষণ এবং দার্শনিক কাকাটিকে ভ্রূ কুঁচকে দেখে বলে, তুমি একদম ফিলজফার হয়ে যাচ্ছ।
যাচ্ছি না। গেছি। –বলে আর-একটা সরু মাদ্রাজি চুরুট সযত্নে ধরিয়ে নেন দিগিন। সোয়া আটটা বাজে, এক্ষুনি তার তৃতীয় কাপ চা আসবে। ত্রিশ টাকা কিলোর চা, গন্ধে ঘর মাত হয়ে যায়। সম্ভাব্য চায়ের কথা ভাবতে তিনি স্ফুর্তিযুক্ত হয়ে বলেন, যা গেছে। ছেড়ে দাও। ওইটাই শেষ পর্যন্ত টিকবে।
যে টাকাটা লস হল তাতে তোমারও শেয়ার আছে, ভুলে যেয়ো না।
ভুলিনি বলেই তো বলছি। আরও যা লস হবে তাতেও আমার শেয়ার থাকবে। বিপদে পণ্ডিতরা অর্ধেক ত্যাগ করেন।
শানু একটা বড় শ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সে যেতে-না-যেতেই পুন্নি চা নিয়ে আসে।
ছোটমামা।
হু।
চা।
হু।
ঠক করে চা টেবিলে রেখে পুন্নি বলে, কারা যেন আসছে আজকে আবার।
দিগিন অবাক হয়ে বলেন, কারা?
কী জানি!– পুন্নি ঠোঁট উলটে বলে, শুনছি কারা যেন আসবে।
কত কে আসে।–দিগিন দার্শনিকের মতো বলেন, কার কথা বলছিস?
তুমি বুঝি জানো না? কে এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাবা আসবে, সবাই বলছে।
ও– বলে দিগিন সুগন্ধী চায়ে চুমুক দেন। আগুন-গরম চা। গরম ছাড়া খেতে পারেন না দিগিন। দোতলায় উঠতে উঠতে ঠান্ডা মেরে যায় বলে দোতলায় পাশের ঘরেই চায়ের সরঞ্জাম রাখেন দিগিন। পুন্নি ঠিক সময়ে আসে, নিঃশব্দে চা করে দিয়ে যায়। ওর হাতে চামচ নাড়ার বা কেটলির হাতলের কোনও শব্দ হয় না। ভারী লক্ষ্মী মেয়ে।
তা কী করবে?— পুন্নি জিজ্ঞেস করে।
কী করব? এলে আসবে।
আমি সামনে যাব না।
সামনে যাওয়ার জন্য যাবি কেন? চা-টা দিয়ে আসবি। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাবটা দিবি। তার বেশি কিছু করতে হবে না।
আমি সামনেই যাব না।
কেন?
আমার ভাল লাগে না।
ও।–বলে দিগিন হাত বাড়িয়ে রেডিয়োটা চালিয়ে দেন। লোকগীতি হচ্ছে। লোকগীতি মানেই দমের খেলা। দিগিন রেডিয়ো বন্ধ করে দেন। পায়ের পাতার ও পাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘে ঢাকা পড়েছে।
ছোটমামা।
হু।
আমি যা বলেছি শুনেছ তো?
শুনলাম।
আমি সামনে যাব না।
আচ্ছা।
আচ্ছা বললে হবে না। তখন মা চেঁচাবে, বাবা বকবে, বড়মামা আর মেজমামা তম্বি করবে, তা হবে না। আমি তোমাকে বলে রাখলাম, তোমাকে সামলাতে হবে সব দিক।
দিগিন ‘হু’ দেন।
ঠিক তো?– পুন্নি সন্দেহে জিজ্ঞেস করে।
হু।
কী করবে?
তোর বদলে দকলীকে দেখিয়ে দেব।
টের পাবে না?
টের পাবে কেন? এত বড় সংসারে কত মেয়ে, কারটা দেখে যাচ্ছে তার ঠিক কী? দলীও তো আমাদের ভাগনিই। তোর চিন্তা নেই।
পুন্নি মুখ বেঁকায়। বলে, আহা।
দিগিন বলেন, কী হল?
পুন্নি শ্বাস ফেলে বলে, দকলী ঠিক ধরা পড়ে যাবে।
ধরা পড়ার কী? চুরি করছে নাকি? তুই বিকেলের দিকটায় বরং বাড়িতে থাকিস না।
পুন্নি উত্তর না দিয়ে জোরে পা ফেলে হেঁটে যায়।
বহুকাল আগে দিগিন এক বার একটা কাণ্ড করেছিলেন। কয়েকজন ডাকসাইটে মাতালকে নেমন্তন্ন করেছিলেন সে বার। তার আগের দিন একটা প্রকাণ্ড তরমুজ কিনে এনে তার এক দিকে ফুটো করে সব শাঁস বের করে ফেলেন, তারপর সেটাতে ধেননা, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, রাম, জিন ইত্যাদি ভরে ফুটোটা বন্ধ করে দেন। একটা ছোট ভাইপোকে ডেকে এনে ঘরের এক ধারে তাকে বসিয়ে অন্য ধারে নিজে বসেন। তরমুজটাকে এক বার ভাইপোর দিকে গড়িয়ে দেন, ভাইপো আবার তার দিকে গড়িয়ে দেয়। এইভাবে ঘণ্টাখানেক গড়াগড়ি খেয়ে তরমুজটা কী মারাত্মক অ্যাটম বোম তৈরি করে রেখেছিল পেটের মধ্যে, তার কোনও ধারণা ছিল না দিগিনের। পরের দিন বন্ধুরা এসে পৌছুনোর আগেই তিনি জিনিসটা একটু গেলাসে ঢেলে চাখতে গিয়ে সেই যে দুনিয়ার বার হয়ে। গেলেন, ফিরে আসতে পরদিন সকাল। বন্ধুরা যথাসময়ে এসেছিল। কিন্তু মাতাল হলেও তারা মৃত্যুশীল এবং সকলেরই কিছু প্রাণের মায়া কম নয়। দিগিনের অবস্থা দেখে ওই তরমুজের ধারেকাছেও তারা ঘেঁষেনি। দিগিনের আজও মনে পড়ে সেই মারাত্মক নেশার পর শরীরের মধ্যে যে গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, কাল রাতে বিয়ার দিয়ে ঘুমের বড়ি খাওয়াতেও তেমনি কিছু গোলমাল হয়ে গেছে। তবে জীবনটাকে নানা এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই আদতে জীবন। আলো যেমন প্রতিহত না হলে আলো বলে মনে হয় না, জীবনটাও কি তাই নয়?