নেপালি আর ভূটিয়ার মিশ্রণে দো-আঁশলা একটা লোক এক বার একটা চায়ের দোকান করেছিল মহানন্দা ব্রিজের উত্তরে। খুবই রহস্যময় দোকান। লোকটার এক ছুকরি বউ ছিল, নাম ছিপকি। দু’ গালে অজস্র ব্রণ, রোগাটে চেহারা। অনাহার এবং অর্ধাহারের গভীর চিহ্ন ছিল চোখের কোলে, গালে। রহস্যময় সেই দোকানের সামনের দিকে সেই দো-আঁশলা লোকটা রুটি, চা, বিস্কুট এবং ডিম বেচত। আর পিছনের খুপরিতে বিক্রি হত ছিপকি আর চোলাই। সঙ্গে মেটে চচ্চড়ি কি তেলেভাজা। একটু নিচু শ্রেণির মানুষেরাই ছিল সেই দোকানের খদ্দের। সন্ধেবেলা বেশ ভিড় হত। ছিপকি তার স্বামীর সঙ্গে সামনের দোকান সামলাত, চোখে কাজল, চুল খোঁপা করে বাঁধা, হাতে কাচের চুড়ি, রঙিন সস্তা শাড়ি পরনে, খুব হাসত আর চোখ হানত। ভিতরের ঘর থেকে মাতালদের স্খলিত গলার নানান শব্দ আসত। ছিপকির স্বামী মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে নোংরা পরদার আড়ালে চোলাইয়ের খদ্দেরদের পরিচর্যা করে আসত। লোকটা ছিল আধবুড়ো, খুব গম্ভীর, দার্শনিকের মতো মস্ত কপাল ছিল তার। একসময়ে মিলিটারির ল্যান্সনায়েক ছিল বলে শোনা যায়। মিলিটারির মতোই আবেগহীন স্বভাব ছিল তার। পরনে চাপা পাজামা গায়ে কোমরের বহু ভাঁজের কাপড়ের বন্ধনীতে গোঁজা থাকত কুরি। নেপালিরা কোমরে যে চওড়া করে কাপড়ের বন্ধনী বাঁধে তার একটা কারণ পেটটাকে গরম রাখা। পাহাড়ি অঞ্চলে পেটে ঠান্ডা লেগে এক রকমের হিল-ডায়েরিয়া হয়, সহজে সারে না। দিগিনও পাহাড়ে গেলে কোমরে পেট ঢাকা কাপড় বাঁধতেন নেপালিদের দেখাদেখি।
মাতাল আর চা-পিপাসুদের সকলেই ছিপকিকে চাইত। কিন্তু সকলের পকেটে তো পয়সা নেই। যাদের আছে তারা একটু বেশি রাতের দিকে ছিপকির স্বামীর সঙ্গে দরদস্তুর ঠিক করে নিত। পিছনের খুপরিতে চলে যেত ছিকিকে নিয়ে। সামনের দোকানটায় লোকটা নির্বিকার বসে থাকত। তার সামনে উনুনে চায়ের জল ফুটছে, একটা ঘেয়ো কুকুর বসে আছে দোরগোড়ায়। সামনে অন্ধকার, নদীর জল ছুঁয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এই রকমই ছিল লোকটা।
কপিল সেখান থেকে গরমি রোগ নিয়ে আসে। দিগিন তাকে দু’বার চিকিৎসা করে ভাল করলেন। অবশ্য চিকিৎসার খুব সুবিধে হয়ে গেছে আজকাল। সিফিলিসের অমোঘ ওষুধ পেনিসিলিনে বাজার ছাওয়া। কিন্তু দিগিন সেটুকু করে ক্ষান্ত হননি। মহানন্দা পূলের কাছে ওই দোকানটা যেতে-আসতে চোখে পড়ত, ভিড় দেখতেন, ছিপকিকেও দু-চারবার লক্ষ করেছেন, কপিলকে যেখানে প্রায়ই দেখা যেত।
একদিন শীতকালে শালবাড়ি থেকে ফেরার পথে জিপ থামালেন। হাড় ভেঙে যাচ্ছে উত্তরে বাতাসে। অন্তত চার-পাঁচ পেগ নিট হুইস্কি ছিল পেটে। মেজাজটা দুরন্ত ছিল। সোজা দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী পাওয়া যায়?
সে রাতে ছিপকির বোধ হয় খদ্দের জোটেনি। সাজগোজ করে একটা ভুটিয়া ফুলহাতা মেয়েলি সোয়েটার পরে ঘোমটায় কান-মুখ ঢেকে আগুন পোহাচ্ছিল। লোকটা একটা ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কুচিয়ে রাখছে। দু-চার জন চায়ের খদ্দের বসে হাঁ করে ছিপকিকে দেখছিল, বিনা পয়সায় বিনা বাধায় যতটা দেখা যায়। ইয়ার্কি-টিয়ার্কিও বোধ হয় করছিল, কারণ দিগিন যখন ঢোকেন তখন ছিপকি একজনের দিকে চেয়ে হাসছিল। দিগিন দেখলেন মেয়েটির হাসি বড় চমৎকার। মুখটা পালটে যায়। কিশোরীর মতো সরলহৃদয়া হয়ে ওঠে। দিগিনকে অনেকে চেনে, দোকানে ঢোকা মাত্র খদ্দেরদের কয়েকজন পয়সা দিয়ে পালিয়ে গেল। এক-আধজন যারা বসে ছিল তারাও গরম চা হুস হাস করে মেরে দিয়ে উঠে গেলে ছিপকির চোখে একটু বিস্ময় ফুটে উঠেছিল, সামনে জিপ দাঁড়িয়ে, দিগিনের মতো সুপুরুষ চেহারার মানুষ, লোকটার চারদিকে যেন টাকা আলো দিচ্ছে, এ মানুষ এখানে কেন?
ছিপকির স্বামীর সে-সব নেই। দিগিন জিজ্ঞেস করলেন দ্বিতীয়বার, কী পাওয়া যায় এখানে?
লোকটা উনুন থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে নির্বিকার গলায় বলে, চা, রুটি, ডিম।
আর কিছু না?
লোকটা দিগিনের দিকে তাকাল না। মাথা নাড়ল। না।
দিগিনের পেটে হুইস্কিটা তখন কাজ করছে, হাতের দস্তানা দুটো খুলে রেখে বেঞ্চে বসে বললেন, মাংস পাওয়া যায় না? মেয়েমানুষের মাংস?
লোকটা ভয় খেয়েছিল ঠিকই। জিপটা দাঁড়িয়ে, দিগিনের চেহারাটাও তার ভাল ঠেকছিল না। তবু বিনয়হীন গলায় বলে, ও সব এখানে হয় না।
দিগিন ছিপকির দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করলেন, দর কত?
ছিপকি একটু দিশাহাবা হয়ে গেল। তার জীবনে এত বড় খদ্দের সে কখনও পায়নি। তাই স্বামীর দিকে চেয়ে নেপালিতে বলল, লোকটা কী বলছে শুনছ?
দিগিন দস্তানাটা টেবিলের ওপর ফটাস করে একবার আছড়ে বললেন, কুড়ি টাকা?
তখন টাকার দাম যথেষ্ট। অত টাকা কেউ দেয় না ছিপকিকে। মেয়েটা দিগিনের দিকে একবার চেয়ে স্বামীর কাছে গিয়ে নিচু স্বরে কী বলল।
দিগিন গরম খেয়ে বললেন, পঞ্চাশ টাকা!
বলেই কোটের ভিতর-পকেট থেকে অন্তত সাত-আটশো টাকার একটা গোছা বের করে প্রকাশ্যে পাঁচখানা দশ টাকার নোট গুনে বের করে নিলেন। লোকটা আড়চোখে দেখল, ছিপকি তার কঁধ খামচে ধরে ঝাকুনি দিয়ে অস্ফুট গলায় কী যেন বলে। এত টাকা দেখে সে পাগল হয়ে গেছে। ছোটলোক, দুর্গন্ধযুক্ত, মাতাল এবং নীচ স্বভাবের লোকদের সঙ্গ করে সে ক্লান্ত। সেই মুহূর্তেই সে যেন সেই ক্লান্তিটা টের পেল। নতুন লোকটা তার কাছে শীতরাতে যেন স্বর্গ থেকে খসে-পড়া দেবদূত।