সেই লাইন নেই, গাড়ি চলে না, স্টেশন কবে উঠে গেছে। তবু রয়ে গেছে একটি বীজ! কবে যেন অতীতের বাতাসে খসে পড়েছিল দিগিনের হৃদয়ে। আজ বয়সের বর্ষা পেয়ে ডালপালা ছড়িয়েছে, দৃশ্যটা ভোলেননি দিগিন।
দিগিনের পাশ দিয়ে একটা জিপগাড়ি চলে যেতে যেতে থামল। দিগিন মুখ তুলে দেখলেন, তারই জিপ, শানুই এখন এটা ব্যবহার করে। ড্রাইভার রমণীমোহন গাড়িটা সাইড করিয়ে রাখল। জিপের পিছন থেকে কপিল নেমে এল।
কালো বেঁটে এবং মজবুত চেহারা কপিলের, চোখে ধূর্তামি, মুখে একটি নির্বিকার শয়তানি ভাব, বহুকাল কপিল দিগিনের কারবারে আছে।
কপিল দিগিনকে জানে। দিগিনও কপিলকে জানেন। এই জানাজানির ব্যাপারটা বহুকাল ধরে হয়ে আসছে, আজও শেষ হয়নি।
শিলিগুড়ির তল্লাটে কপিলের নাম কীর্তনিয়া বলে। ভালই গায়। বিভোরতা আছে, ভক্তিভাব আছে। অবরে সবরে গাঁ-গঞ্জ থানা থেকে তার ডাক আসে। ছোট মাপে সেও নামজাদা লোক। নিজের সেই মর্যাদা সম্পর্কে সে সচেতনও। মুখখানা সবসময়েই গম্ভীর হাসিহীন। কথাটথা কমই বলে। একমাত্র দিগিন ছাড়া সে আর কারও বড় বাধ্য নয়। শানু ওকে সামলাতে পারে না, প্রায়ই দিগিনকে এসে বলে, তোমার কপিলকে নিয়ে আর পারা যায় না, ওকে তাড়াও।
দিগিন তাড়ান না।
সে আজকের কথা তো নয়। তখন সাহেবদের আমল। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে পুরনো আমলের ব্রডগেজের দার্জিলিং মেল এসে থামত সকালবেলায়। সাহেবদের বড় প্রিয় ছিল দার্জিলিং। ফার্স্ট ক্লাস বোঝাই লাল রাঙা সাহেবরা নামত কুকুর, মেমসাহেব আর নধর বাচ্চাদের নিয়ে। সরাবজির জাল-ঢাকা চমৎকার রেস্টুরেন্টে বসে ব্রেকফাস্ট খেত। তারপর দার্জিলিঙের ছোট গাড়িতে উঠত। টাউন স্টেশন তখন ঝকঝক করত। এখনকার মতো পাঁজরা-সার হায়-হতভাগা চেহারা ছিল না। কপিল ছিল সেই সময়কার টি-আই সাহেবের সেলুন বেয়ারা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান টি-আই সাহেব লোেক খারাপ ছিল না, কিন্তু কপিলটা ছিল হাড়-হারামজাদা। সরাবজি থেকে সাহেবের নাম করে দু’ বোতল বিলিতি হুইস্কি হাতিয়েছিল, তাই চাকরি যায়। চাকরি যাওয়ার পর কিছুকাল বড় কষ্টে গেছে। সেই কষ্টের দিনে একটামাত্র মেয়ে মল্লিকাকে রেখে কপিলের বউ মরল। মল্লিকা তখন দু-আড়াই বছরের, মা-মরা একলা, কপিল সেই মেয়ে রেখে কোথাও যেতে পারত না। পায়খানা পেচ্ছাপের সময়েও মেয়েকে কোলে নিয়ে গিয়ে বসত। আবার বিয়ে করবে তেমন। মুরোদ নেই, নিজেরই তখন প্রায় ভিক্ষে-সিক্ষে করে চলছে।
তখন দিগিনের বাড়ি আসত। ঘরদোর সাফ-সুতরো করত, পয়সাকড়ি হাতাত, ফাঁক পেলে চুরি করে দিগিনের বোতল ফঁাক করত। এখন দিগিনের বাড়িতে যেখানে বড়দাদা পাকা বাড়ি তুলেছে সেখানে কপিল একদা চমৎকার একটা বাগান করেছিল, মল্লিকাফুল যে আসলে বেলফুল তা কপিলই শিখিয়েছিল দিগিনকে, কপিলের জন্য দিগিনের মায়াদয়া তেমন ছিল না, ছিল ওই মেয়েটার জন্য। ট্যাপাটোপা দেখতে ছিল মেয়েটা, বাপ দিগিনের বাগান করত, মেয়েটা বাপের কোপানো জমির মাটির ঢেলা ছোট দুই হাতে চৌরস করত দিনভর রোদে বসে। বাপ ঘর ঝাট দিচ্ছে তো সেও একটা ন্যাতা বুলিয়ে কাঠের মেঝে মুছতে লাগত নিজের মতো করে। বদলে বাপ-বেটিতে পেটভরে ভাত খেত দুপুরে, রাতের ভাত গামছায় বেঁধে নিয়ে যেত। তখন মাঝে-মাঝে রাঁধতও কপিল, মুরগির ঝোল, ডিমের ডালনা, খিচুড়ি।
মেয়েটাই ছিল কপিলের জীবনসর্বস্ব। মেয়ে কঁাধে সর্বত্র চলে যেত সে। কাছছাড়া করত না। গ্রামগঞ্জে মেয়ে সঙ্গে করেই কীর্তন করে বেড়াত। বাপের গায়ের গন্ধে, শরীরের ছায়ায় মেয়েটা পাঁচ বছর পর্যন্ত বেড়ে উঠল। তারপর ধরল ম্যালেরিয়ায়। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার এক ধাক্কায় নিভে গেল মেয়েটা। মেয়ে-হারা বাপ সক্কালবেলায় কারও কাছে না গিয়ে খবরটা দিতে এল দিগিনকে। ডাকেনি, শব্দ করেনি। দিগিন তখনও ওঠেননি ঘুম থেকে, শেষরাতে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল টংগি ঘরের বারান্দায়। শিলিগুড়ির সেই দুর্দান্ত শীতে গায়ে গেঞ্জির ওপর কেবলমাত্র চ্যাটার্জি সাহেবের বুড়ি পিসি কীর্তন শুনে মরার আগে যে নামাবলীটা দান করে গিয়েছিলেন কপিলকে, সেইটে জড়াননা। দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। বাক্যহারা, বোধবুদ্ধি নেই, কেবল ঢোক গিলছে আর থুথু ফেলছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা আর কীর্তনের দলের বন্ধুরা মেয়েটাকে নিয়ে গেছে শ্মশানে। এই সময়টায় সারা দুনিয়ার মধ্যে কপিল কেবল দিগিনকে মনে রেখে তারই কাছে চলে এসেছিল।
আজও কপিলের দিকে তাকালে সেই কপিলকে দেখতে পান দিগিন, শানু তাড়াতে বলে, তাড়ানো কি সোজা? সেই মেয়ে-হারা বাপটিকে আজও দিগিন মনের কপাট খুললেই দেখতে পান যে।
দিগিন জানেন, কপিল লোেক ভাল নয়। চুরি-চামারি তো আছেই, চরিত্রের অন্য দোষও আছে। মেয়ে মরার পর কপিলকে নিজের কারবারে রাখলেন দিগিন। নানা রকম কনস্ট্রাকশনের কাজে বহু হাজার টাকার মালপত্র এখানে-সেখানে পড়ে থাকে। সে-সব পাহারা দেওয়ার জন্য চৌকিদার রাখতে হয়। সে আমলে নেপালিরাই এই কাজ করে বেড়াত। দিগিনেরও কয়েকজন নেপালি চৌকিদার ছিল। তাদের দলে কপিলকে ভিড়িয়ে নিলেন, কাঙালকে শাকের খেত দেখিয়ে দেওয়া হল। কৃতজ্ঞতাবোধ কিছু কমই ছিল কপিলের। রড, সিমেন্ট, কাঠ, রং, সে কিছু কম চুরি করেনি। তবু দিগিনের প্রতি তার একরকম আনুগত্য আর ভালবাসা আছে। জিনিস না-বেচলে তার চলত না। ধরলে টপ করে স্বীকার করত।