চেকটা দেখে পুন্নির বাবা অবাক হয়ে বলেন, এখনই কেন?
আমি কালিম্পং যাচ্ছি আজই। বেশ কিছুদিন থাকব না। যদি ছেলের বাবা আসে তবে টাকাটা যে-কোনও অজুহাতে শো করবেন!
পুন্নির বাবা মাথা চুলকোন! অনিচ্ছুকভাবে বলেন, আচ্ছা।
দিগিন আর কোনও দিকে মনোযোগ দেন না। বেশ কিছুদিন থাকব না, এ কথাটা তিনি কেন বললেন? কালিম্পঙে তার তো থাকার কথা নয়! পুন্নির বাবা চলে যান। দিগিন সবিস্ময়ে আবার কাঞ্চনজঙ্ঘার নিস্তব্ধতার দিকে চেয়ে থাকেন। কালিম্পঙে যদি যেতে হয় তবে এক্ষুনি তোড়জোড় করা দরকার। জিনিসপত্র গোছাতে হবে, জিপটা রেডি রাখতে হবে, দু-চার জায়গায় দেখা করেও যেতে হবে। কিন্তু সেসব জরুরি কা পড়ে থাকে। দিগিন পুন্নিকে ডেকে এক কাপ চা করতে বলে বসে থাকেন চুপচাপ। ফটিক লাহিড়ির কথা অকারণে কেন যে মনে হচ্ছে। সরু মাদ্রাজি চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধের মধ্যে বসে থাকেন দিগিন। সামনে সোনালি সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর নীল আকাশ।
.
টাকা–এই শব্দটাই অদ্ভুত। মানুষের ভিতরে ওই শব্দটা ঢুকে গেলেই টরেটক্কা বেজে উঠতে থাকে, মানুষ আর মানুষ থাকে না।
মোটর-সাইকেলটার একটা পিন ভেঙেছে। পাঁচ-দশ টাকার মামলা। অমর সিংয়ের গ্যারেজে সারাতে দিয়ে দিগিন রাস্তায় পায়চারি করেন। মিস্ত্রিটা উঠে এসে বলল, একটু সময় লাগবে। আপনি চলে যান না, সারিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দিগিন লোক চেনেন। চোখের আড়াল হলেই ওদের জো। তখন পিন-এর সঙ্গে এটা ভেঙেছে, ওটা পুরনো হয়েছে, সেটা পালটানো দরকার বলে নানারকম সারাইয়ের ফিরিস্তি দিয়ে বিল পাঠাবে বাড়িতে।
দিগিন মাথা নেড়ে বললেন, না রে, জেলখানায় ঢালাইয়ের কাজ হবে, এক্ষুনি যাওয়া দরকার।
উত্তর দিকে চেয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকেন দিগিন, শরতের মেঘকাটা আকাশ। বর্ষার জলে বাতাসের ধুলোকণা ধুয়ে গেছে। পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়, আর ঝকঝকে পাহাড়। সামনের পাহাড়ের রং মোষের গায়ের মতো ভুষকো, তার পিছনে রুপোর কাঞ্চনজঙ্ঘা। ডান দিকে আরও কয়েকটা রুপোলি চূড়া, কত বছর ধরে দেখছেন, তবু পুরনো হয় না।
উত্তরবাংলার কিছুই পুরনো হয় না। তবু কিছু কিছু হারিয়ে গেছে মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায়। ন্যারোগেজের একটা লাইন ছিল কালিম্পঙের দিকে, নদীর ধার দিয়ে, পাহাড়ের কোলে কোলে যেত ছোট্ট রেলগাড়ি গেইলখোলা পর্যন্ত। দার্জিলিঙের মতো অত চড়াই-উতরাই ছিল না, ছিল না। অত রিভার্স আর লুপ। মায়াবী মাঠ প্রান্তর, ছোট ঘোট কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়, নদীর খাত বেয়ে সেই ছোট ট্রেন বয়ে আনত সিকিমের কমলালেবু, কাঠ, আপেল। সেই লাইন নাকি তেমন লাভজনক হচ্ছিল না, তাই রেল কোম্পানি লাইন তুলে দিল। ওই স্বপ্নের রেলগাড়ি উঠে যাওয়ার পর বহুকাল দিগিনের মন খারাপ ছিল। মংপু বা কালিম্পঙে যেতে হলে বরাবর ওই ট্রেনে চেপে যেতেন দিগিন। রিয়াত স্টেশন থেকে একটা রোপওয়ে ছিল। সেই রোপওয়ে দিয়ে মাল এবং মানুষ দুই-ই যেত। দিগিনও গেছেন। আর যাওয়া যেত খচ্চরের পিঠে। তখনও কালিম্পঙে মোটর গাড়ির রাস্তা হয়নি। কিছুক্ষণ যেন রূপকথার রাজ্যে থেকে আসতেন। মাঝপথে একটা স্টেশন ছিল, নামটা মনে পড়ছে না, বহুকাল হল উঠে গেছে। এক দুপুরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে, দিগিন চা খেতে নামলেন। তখন যৌবন বয়স। প্লাটফর্মের গায়ে প্রচণ্ড কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে। ছোট্ট কাঠের স্টেশন ঘর, চারদিকে। খেলনা-খেলনা ভাব, ছোট লাইন, ছোট সিগন্যাল, ছোট নিচু প্লাটফর্ম। তার চারদিকে সেই খেলাঘরের স্টেশন, ডান দিকে নদীর খাত, দু’ধারে পাহাড়ের বিশাল ঢাল। দিগিন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন, দেখলেন কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে। আড়াই কি তিন বছর বয়স, গোলগাল চেহারা, শীতের চিমটিতে গালদুটো লাল, ফাটা গা, শীতের সোয়েটার গায়ে, পরনে প্যান্ট। কিন্তু দুষ্টু ছেলে সোয়েটার টেনে তুলে ফেলেছে বুকের ওপর, পেটটা উদোম। দু’ মুঠিতে কিছু কঁাকর আর ধুলো কুড়িয়ে নিয়েছিল। তারপর হঠাৎ খেলা ভুলে চেয়ে আছে দুরের দিকে। দুই পাহাড়ের মাঝখানের খাত বেয়ে গর্জে চলেছে দুরন্ত ফেনিল তিস্তা, তার দুরন্ত শব্দ গমগম করে প্রতিধ্বনি হয়ে আসছে, কাজলপরা দুই চোখে শিশু হা করে দেখছে, কতকাল আগেকার সেই দৃশ্য, আজও ভোলেননি দিগিন। বড় মায়া ঘনিয়ে উঠেছিল বুকে, সেই শিশুটির ধারেকাছে কেউ ছিল না। একা। খেলতে খেলতে খেলা ভুলে একা মুগ্ধ-বিস্মিত চোখে দেখছে, দিগিন হাতের কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেলেন, গাড়ির হুইসল যতক্ষণ না বাজল ততক্ষণ ভিখিরির মতো, কাঙালচোখে চেয়ে রইলেন তার দিকে। কোলে নেননি, আদর করেননি। কিন্তু আজও এত বছর পরেও প্রায়ই যখন মনে পড়ে, তখন কত আদর যে করেন। সে কত বড় হয়েছে। এখন, সংসারীও হয়নি কি! কিন্তু সে-সব মনে হয় না। কেবল দিগিনের মনের মধ্যে শিশুটি আজও অবিকল ওই কয়েক মুহূর্তের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, দু’হাতে দু’মুঠো ধুলো, আদুড় পেট, চোখ লেপটানো কাজল, আর তাব চারধারে বিশাল পাহাড়, গতিময় প্রচণ্ড নদী, তার শব্দ, একা সে দাঁড়িয়ে।
চোখে কেন জল আসে! দৃশ্যটা ভাবলেই আসে, অথচ করুণ দৃশ্য তো নয়। তবে বুঝি সৌন্দর্য জিনিসটাই ও রকম, বুক ব্যথিয়ে তোলে। না কি শিশুটি নাড়া দেয় অক্ষম পিতৃত্বকে? কী হয়, কে জানে! একটা কিছু হয়। নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পান নাকি। পৃথিবীর অঢেল সম্পদ নিজের জন্যে খেলার ছলে আহরণ করতে করতে তিনি নিজেও কি মাঝে মাঝে খেলা ভুলে চেয়ে থাকেন না কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে!