তবে ময়নার কাছে তাকে রাখতে চেয়েছিলে কোন সাহসে?
আমি তোমাকে যথাসময়ে বলতাম।
না বললেও আমি জেনেছি। বলে রাখছি, তা হবে না।
ঠিক আছে।— বলে শানু মুখ ফিরিয়ে নেয়।
দিগিন বলেন, কী ঠিক আছে? স্পষ্ট করে বলল।
আমি কাকিমার কাছে ওকে রাখব না।
তা হলে কোথায় রাখবে?
অন্য কোথাও।
রাখবেই?
শানু চুপ করে থাকে।
দিগিন আস্তে করে বলেন, না।
শানু তাকায়। বলে, উপায় নেই ছোটকাকা।
দিগিন উত্তেজনাটা রাশ টেনে ধরেন। বলেন, তুমি কাল যাচ্ছ কি না?
যাচ্ছি তো বললাম।
দিগিন মাথা নাড়েন। বলেন, কালিম্পঙ আর এম-ই-এস-এর কাজ আমি দেখব। ঠিক আছে?
শানু মৃদুস্বরে বলে, কিন্তু কালিম্পঙে তুমি যে জন্যে যাচ্ছ তা হবে না।
কী জন্যে যাচ্ছি তা বুঝলে কী করে?
বুঝেছি। তুমি গোলমাল কোরো না। লাভ হবে না।
দিগিন হাসেন, বলেন, শানু, দিগিন চ্যাটার্জি এখনও বহুকাল বাঁচবে।
শানু উত্তর দিল না।
দিগিন ধীরে ধীরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তার ঘরে চলে আসেন। একটু ঠান্ডা পড়েছে আজ। একটা চাদর নিয়ে বিছানায় যাওয়ার আগে বিয়ার দিয়ে দুটো ঘুমের বড়ি খেলেন। বাতি নিভিয়ে কাচের শাসি দিয়ে চেয়ে রইলেন উত্তরদিকে। পাহাড় মুছে গেছে। একটা অদ্ভুত জ্যোৎস্না উঠেছে। কুয়াশার আবছায় ড়ুবে আছে শহর। নেশাটা আজ ধরছে না তেমন। তবু হাই উঠছে। ঘুম পাচ্ছে। তবু ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। সংসারে কিছুই তার নয়। তবু সবই তাকে কেন যে ভাবতে হয়।
ঘুমচোখেই দুটো চেক লিখলেন দিগিন। একটা পুন্নির বাবার নামে। অন্যটা চ্যাটার্জি কনস্ট্রাকশনের শান্তি চ্যাটার্জির নামে। চেক দুটো সই করে রেখে দিলেন টেবিলে। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
ভোরবেলা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন তিনি। সেবকের করোনেশন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পায়ের নীচে, বহু নীচে তিস্তা। তিস্তার দু’ধারে খাড়া পাহাড় দুটোকে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে বিখ্যাত করোনেশন ব্রিজ। হঠাৎ দেখেন একটু দুরে দুই পাহাড় থেকে কে যেন একটা দোলনা দুলিয়েছে। সেই দোলনায় স্কুল খাচ্ছে একটা লোক। লোকটা চেনা। বহুকাল আগে শিলিগুড়িতে যখন প্রথম এসেছিলেন তখনকার চেনা। ফটিক লাহিড়ি। লাহিড়ি দোল খাচ্ছে, আর ভয়ে চিৎকার করছে। দিগিন হাতের রাইফেল তুলে লাহিড়িকে একবার নিশানা করে গুলি করলেন। ফসকাল, দিগিন আবার নিশানা স্থির করেন.পর পর কয়েকটা গুলি করেন দিগিন। লাগল না, কিন্তু লাহিড়ি চিৎকার করতে লাগল।
ঘুম ভেঙে যায় অস্বস্তির সঙ্গে। শুনতে পান দল্লীর মা চেঁচিয়ে সুর করে গাইছে, ও স্বামী তুই মর, ও স্বামী তুই মর। বোধ হয় মাথাটা আবার গরম হয়েছে। সারা দিনই হাসে, কাঁদে, গায়। দীর বাপ চিৎকার করে ধমকাল। অশান্তি। সংসার জিনিসটার রহস্য কখনও বোঝেননি দিগিন। ঘুমভাঙা চোখে তিনি একটু অবাক হয়ে হঠাৎ ফটিক লাহিড়ির কথা ভাবলেন। লাহিড়িকে স্বপ্নে দেখার কোনও মানেই হয় না। বহুকাল আগে লাহিড়ি মারা গেছে, গুলি খেয়ে নয়, সাধারণ কতগুলো রোগে ভুগে। তাকে এতকাল পরে স্বপ্নে দেখার মানে কী?
.
রাতে ভাল ঘুম হয়নি। সেই যে লাহিড়িকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভাঙল তারপর থেকে দিগিন জেগেই ছিলেন। সকালে পুন্নি যখন চা করতে এল তখন দিগিন উত্তরমুখো ইজিচেয়ারে বসে নিজের পায়ের পাতার ফাঁক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছেন। চোখে কটকট করে আলো লাগছে।
পায়ের পাতায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢেকে দিগিন বলেন, আমার চায়ে দুধ-চিনি দিস না।
কেন?
লিকার খাব।
পুন্নি তা-ই এনে দেয়।
দিগিন চায়ের লিকাবে খানিকটা হুইস্কি মিশিয়ে খেলেন। চুরুট ধরিয়ে নিলেন। শরীরটা ভাল নেই। কালিম্পং যেতে তার মোটেই ইচ্ছে করছে না। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
কুষ্ঠিত পায়ে শানু এল। পরনে বাইরে যাওয়ার পোশাক। মুখটা একটু শুকনো।
ছোটকাকা।
উ।
ঘুমোচ্ছ?
না।
আমি জলঢাকা যাচ্ছি।
কেন?
তুমি বললে যে।
ও।
যাচ্ছি।
যাবে? যাও।
চেকটা লিখে রেখেছ?
হ্যাঁ। টেবিলের ওপর আছে। নিয়ে যাও।
শানু টেবিলের কাছে যায়। চেকটা নেয়। দিগিন ক্লান্তভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে চেয়ে থাকেন। চেকটা আজ ক্যাশ হয়ে যাবে, তারপর যা থাকবে তা ক্যাশ করে নেবে পুন্নির বাবা। তারপরও কিছু থাকবে। কিন্তু সে খুব বেশি কিছু নয়।
সেভিংস অ্যাকাউন্টের চেক। এত টাকার চেক কি বিনা নোটিশে কাশ করবে?–শানু জিজ্ঞেস করে।
দিগিন বুঝতে পারেন ভুল করে সেভিংসের চেক সই করেছেন কাল, আজকাল বড় ভুলভাল হচ্ছে।
ভ্রু কুঁচকে বললেন, করবো ভটচাকে একটা পার্সোনাল চিঠি লিখে দিচ্ছি। প্যাডটা দে আর কলমটা।
শানু প্যাড এনে দেয়। দিগিন খসখস করে দু লাইন লিখে দেন। শানু চলে যেতেই আবার ক্লান্তভাবে বসে থাকেন। সামনে আজ স্পষ্ট ও পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা। বরফাচ্ছন্ন, নিঃশব্দ, ভয়াল, ভয়ংকর। দিগিন চেয়েই থাকেন। কত বছর ধরে তিনি হিমালয়কে দেখেছেন আর দেখেছেন। ওই নিস্তব্ধতা কত বার তাকে কাছে টেনেছে। আজ যেন হিমালয় ছেড়ে তার কাছেই চলে আসছে। তুষারশুভ্র নিস্তব্ধতা। তিনি অপলক চেয়ে থাকেন পাহাড়ের দিকে।
কাল রাতে কেন ফটিক লাহিড়িকে স্বপ্ন দেখলেন তিনি? কোনও মাথামুণ্ডু নেই। তার জীবনের সঙ্গে ফটিক লাহিড়ির কোনও যোগাযোগ নেই।
পুনির বাপকে ডেকে পাঠালেন।
পুন্নির বাবা এসে দাঁড়াতে তেমনি ভটচাযকে দু’লাইনের চিঠি সমেত চেকটা দিয়ে বললেন, এটা আজই ক্যাশ করবেন।