শানু বলে, মানুষ যা-ই বলে বলুক, আমি জানি কাকিমা বলেই।
একটু কর্কশ স্বরে দিগিন বলেন, বুঝলাম, কিন্তু গিয়েছিলি কেন?
সম্পর্কটা সহজ করতে।
সেটা নিয়ে তোর মাথাব্যথা কেন?
শানু গম্ভীর হয়ে বলে, ছোটকাকা, একটা মানুষের প্রতি সারাটা জীবন কেন অন্যায় করে যাচ্ছ?
অন্যায়?
অন্যায় ছাড়া কী? ভাত-কাপড়ের চেয়ে দামি জিনিস হচ্ছে মর্যাদা।
থাক। টাকা চেয়েছিলি কেন?
চেয়েছি ধার হিসেবে।
কেন?
সব টাকা লিকুইডেটেড হয়ে গেছে।
সেটা আমাকে বলিসনি কেন?
বললে তো বকতে।
এখন কি বকব না?
শানু শ্বাস ফেলে বলল, সোপস্টোনের লসটা হিসেব করছিলাম। তোমাকে যা বলেছি তার চেয়ে বেশি লস হবে। বাজারে ধারকর্জ একটু বেশি হয়েছে। জলঢাকায় যে ইরেকশনের কাজটা অর্ধেক বন্ধ রাখতে হয়েছে সেটার বিল আটকে দিয়েছে, লেবাররা খেপে আছে, যাওয়া যাচ্ছে না।
নিজের দু’খানা হাতের দিকে অন্যমনে একটু চেয়ে থাকেন দিগিন, শানুর কোনও কথাই তাকে স্পর্শ করে না। জলঢাকা এম-ই-এস, সোপস্টোন, টাকা, বিল, এ সব কথা একটা জীবনে তিনি অনেক ভেবেছেন। এখন আর ভাবতে ভাল লাগে না। জীবনে সব কিছুরই একটা কোটা থাকে। তার কোটা ফুরিয়েছে। আর কিছু করার নেই বোধহয়।
দিগিন তার চিন্তান্বিত মুখখানা তুলে বলেন, আমার অনেক দোষ ছিল। ছিল কেন বলি, এখনও আছে। লোকে বলে, আমার হৃদয় বলে বস্তু নেই। কিন্তু আমার সদগুণেরও কিছু অভাব ছিল না। আমি সেই জোরেই দু’হাতে টাকা রোজগার করেছি। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার কোনও শর্টকাট রাস্তা আমার জানা নেই। বাজে ফাটকায় বা অনিশ্চিত ব্যাপারে আমিও কিছু ক্ষতিস্বীকার করেছি, কিন্তু কোনও ব্যাপারেই আমার ফাঁকির ফিকির ছিল না। তাই আজও আমি টাকার ওপরে বসে আছি। তোমাদের আমলে তোমরা এই টাকার পাহাড় ধসিয়ে দেবে।
শানু মাথা নিচু করে থাকে। তারপর আস্তে করে বলে, চেষ্টা তো আমিও কিছু কম করি না।
কালিম্পঙে তোমার এখন কী কাজ হচ্ছে?
একটা ব্রিজ কনস্ট্রাকশন, তুমি তো জানোই।
জানি। কিন্তু সে বাবদে তোমার সেখানে গিয়ে পড়ে থাকার মানে হয় না। কাল আমি নিজে সেখানে যাব। তুমি জলঢাকায় যাবে। ইরেকশনের কাজটা শেষ করতেই হবে, মনে রেখো।
লেবাররা ছেড়ে দেবে না। ওদের অনেক টাকা বাকি পড়ে গেছে।
সেজন্য কে দায়ি?
আমরা নই। ইরেকশনের ভুলটা ডিটেকটেড হয়েছে অনেক পরে। এখন নতুন করে করতে গেলে খরচ দ্বিগুণ হত। তাই আমরা ছেড়ে এসেছি।
খরচের ভয় পেলে চলবে কেন? আমার নাম কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তার গুডউইল নষ্ট করার তুমি কে? কালই তুমি জলঢাকা যাবে।
শানু চুপ করে থাকে।
দিগিন বলেন, বুঝেছ?
শানু মাথা নাড়ল।
কালিম্পঙে তোমাকে আর যেতে হবে না।
শানু মাথা তুলে বলে, জলঢাকায় কাজটা আবার হাতে নিলে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাব।
হলে হব। তোমাকে ভাবতে হবে না।
ছোটকাকা।
বলো।
আর-একটু ভেবে দেখো।
ভাববার কিছু নেই। কাজটা করতে হবে।
একটা পয়সাও আসবে না, ঘরের টাকা চলে যাবে।
জানি। আমি বোকা নই।
তবু যেতে বলছ?
দিগিন রাগের গলায় বলেন, শুনতেই তো পাচ্ছ।
ঠিক আছে।
যদি লেবাররা গোলমাল করতে চায় তা হলে কী করবে?
কিছু ঠিক করতে পারছি না।
ব্যাঙ্ক আওয়ার্সের পরে রওনা হোয়ো। টাকা নিয়ে গিয়ে প্রথম লেবার পেমেন্ট করবে। আমাদের ওয়ার্ক অর্ডার এখনও ক্যানসেল করেনি, সুতরাং বাকিটা করতে ঝামেলা হবে না। আমি চেক লিখে রাখছি।
শানু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা।
মনে রেখো লেবার পেমেন্ট সবার আগে।
আচ্ছা।
আর সোপস্টোনের ব্যাপারটা তোমাকে ছেড়ে দিতে বলেছি। তুমি কিছু ভেবেছ?
অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছি।
তবু ছেড়ে দাও।
এটাতে তোমার টাকা ছাড়াও পার্টনারদের টাকা আছে। তারা কী বলবে?
কী বলবে? যদি সন্দেহ করে তবে পার্টনাররা ইনিশিয়েটিভ নিক। তুমি ওটাতে আর টাকা ঢেলো না। ভুটান গভর্নমেন্ট দর কমাবে না।
ভেবে দেখি!
দেখো! আর শোননা, যদি ময়নাকে তোমার কাকিমা বলে ডাকতে ইচ্ছে হয় তো ডেকো। কিন্তু ওকে তোমার স্বার্থে জড়িয়ো না।
শানু মুখটা তুলেই নামিয়ে নেয়।
দিগিন বলেন, বুঝেছ?
শানু মাথা নাড়ল। বুঝেছে।
ময়না আমাকে সবই বলেছে। কিছু গোপন করেনি।
দিগিন উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে এক বার থমকে দাঁড়ালেন। শানুর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু বলার আছে?
শানু তার ছোটকাকাকে চেনে। ভালমানুষ, স্নেহশীল, কিন্তু তবু ছোটকাকা যা চায় সংসারে তাই শেষ পর্যন্ত হয়। কখনও ঈশ্বর, কখনও শয়তান এই মানুষটাকে শানু খুব ভাল করে চেনে, আবার আদৌ চেনেও না। শানু তাই স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ বলে, তুমি যা চাও তাই তো হয় ছোটকাকা।
তাই হবে।
শানু শ্বাস ফেলে বলে, আমি প্রতিবাদ করছি না।
আমিও অবিহিত কিছু করছি না।
কালিম্পঙে আমার যাওয়াটা তুমি বন্ধ করতে চাও কেন?
দিগিন ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। বললেন, বুঝে দেখো।
আমি খারাপ কিছু করছি না।
তবে ময়নার আশ্রয় চেয়েছ কেন? সেখানে আমি তো যাই। আমার চোখ এড়াবে কী করে?
শানু চুপ করে থাকে।
দিগিন শান্ত গলায় বলেন, তুমি ভেবেছিলে তোমার ছোটকাকা যখন ময়নার সঙ্গে একটা অবৈধ সম্পর্ক রেখেছে তখন নিজের দুর্বলতাবশত তোমার যে-কোনও ভাগিয়ে আনা মেয়েকেও সহ্য করবে?
শানু চুপ।
বলো, তাই ভেবেছিলে?
না।