খান না মশাই, দামকে ভয় কী?
দামের জন্য নয়, নেশা হয়ে যাবে।
বোতলটা ভটচাযের হাতের নাগালে রেখে দিলেন, বুঝতে পারেন ‘দামি জিনিস’ কথাটাই ভটচাযকে কাত করবে।
করলও। ভটচায গেলাস শেষ করে বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিলেন, বললেন, দিগিনবাবু, এর জোরেই না এখনও ফিট আছেন। নইলে এখানকার জলহাওয়া সহ্য করেন কী করে?
একজ্যাক্টলি।
ভটচায কথা বলতে থাকেন। প্রথমে চাকরির কথা। তারপর ঘর-সংসারের কথা। কী একটু দুঃখের কথা বলে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলেন। দিগিন চোখ ছোট করে চেয়ে গিনিপিগ দেখতে থাকেন। আজকাল তার বড় একটা নেশা হতে চায় না। কাল রাতে যেমন ঘুমের বড়ি খেয়েছিলেন তেমনি আজও একবার খাবেন নাকি?
ভটচা হেঁচকি তুলে বলেন, শুটকি মাছ!
আসছে।
খুব ভাল জিনিস।
খুব।
বহুকাল খাইনি, আমার বাসায় ওর পাট নেই। ছেলেবেলায় খুব খেয়েছি। আপনার বাসায় রেগুলার হয়?
হয়।
সবাই খায়?
না। আমি খাই আর বড়বউদি। আর কেউ না।
বউ থাকলে সে যদি না খেত তবে আপনারও খাওয়া হত না।
দিগিন হাসেন।
ভটচায হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে বলেন, কিন্তু লোকে বলে আপনার কে একজন আছে।
দিগিন গম্ভীর হয়ে বলেন, কে থাকবে?
একজন মেয়েছেলে!
দিগিন হেসে বলেন, সে তো সবার থাকে।
সবার থাকে? ভটচায হেঁচকি তোলেন।
বিয়ে করলেই থাকে।
না না, বিয়ে করা বউয়ের কথা নয়।
তবু কথা একই, বিয়ে করা বা না করা সবই এক কথা।
ভটচার্য অনেক ভেবে-চিন্তে মাথা নেড়ে বলেন, তা বটে। তা হলে আপনার একজন আছে?
একজন না, কয়েকজন।
কয়েকজন? ভটচাখ চোখ বড় করে তাকাল।
লোকে বলে না সে কথা?
না তো! একজনের কথাই শুনেছি।
লোকে কমিয়ে বলেছে।
রাখেন কী করে? একজনেরই যা খরচ।
রোজগার করি। রাখি!
বেশ খরচা পড়ে, না?
তা পড়ে, ফুর্তিটাও তো কম নয়। মেয়েছেলে, কিন্তু বউ নয়, এর মধ্যে কি কম ফুর্তি নাকি?
ভটচায় মাত্রাহীন টানতে থাকেন পোর্ট। বলেন, বাড়িতে বসে এ সব খান, কেউ কিছু বলে না?
কী বলবে?
আপত্তি করে না?
বাড়িটা তো আমার।
তবু ফ্যামিলিতে কি এ সব চলে?
দিগিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, অত ভাবতে গেলে ফুর্তিই তো ফিকে হয়ে যায়।
তা বটে।
ভাববেন না। কেউ কিছু বলে তো বলুক। আপনার কাজ আপনি করে যাবেন।
কী করব?
ফুর্তি!
এই বুড়ো বয়সে?
ফুর্তির আবার বয়স কী? তা ছাড়া সারাজীবন যদি ফুর্তি না করে থাকেন তো এই শেষ বয়সেই তা পুষিয়ে নেওয়া উচিত। আর তো বেশি সময় নেই। আপনি কিন্তু একটু বেশি খাচ্ছেন।
না, আর খাব না।
খান। ক্ষতি নেই। তবে আর বেশি টানলে খাবার খেতে পারবেন না।
দাঁড়ান। আর দুই চুমুক। আবার অনেকটা খেয়ে ভটচায় একটা প্রকাণ্ড ঢেকুর তুলে বললেন, ওই! গ্যাসটা বেরিয়ে গেল! পেটটা হালকা লাগছে।
লাগবেই তো। দেশিটা খেলে আরও বেরিয়ে যেত।
হ্যাঁ, ফুর্তির কথা কী যেন বলছিলেন? এইটাই ফুর্তির বয়স। মরার পর ওপারে গেলে স্বয়ং যম যখন সওয়াল করবে, বাপু, পৃথিবীর কী কী অভিজ্ঞতা হয়েছে তোমার, কী কী ভোগ করে এলে, তখন কী বলবেন? বলার কিছু আছে? ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করে নাকিসুরে তখন পেটের রোগ, বউয়ের মেজাজ, প্রোমোশনের দেরি, ডেবিট, ক্রেডিট, এ সবই বলতে হবে। যম তখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে, বলবে, যাও, দুনিয়াটা আবার দেখে এসো, কিছুই দেখনি।
ভটচাযের চোখ দুখানা রক্তাভ। সেই চোখে দিগিনের দিকে চেয়ে বলেন, শুটকি মাছ?
হবে। আর একটু খিদেটা চাগিয়ে নিন।
ভটচায মদে সম্পূর্ণ ভেসে যাওয়ার আগে আবেগ-খলিত কণ্ঠে বলেন, বাড়িতে বড় ধরাকাটা! কিছু খেতে-টেতে দেয় না মনের মতো। বহুকাল ধরে ডিপ্রেশনে আছি। যদি পেটটা ঠিক থাকত, যদি প্রেশারটা উৎপাত না করত।
খাবার দিয়ে গেল চাকর। ভটচায দু’চামচ ফ্রায়েড রাইস খেলেন, এক টুকরো মাংস, শুটকি মাছের চচ্চড়িটা মুখে তুললেন মাল, খেতে পারলেন না। তারপরেই গেলাস রেখে চেয়ারে এলিয়ে বসে চোখ বুজলেন। আস্তে করে বললেন, বউ বাচ্চা সব পাঠিয়ে দিয়েছি কোন্নগর। সেখানে আমার বাড়ি হচ্ছে। যে কদিন আছি রোজ আসব, বুঝলেন?
নিশ্চয়ই। দিগিন বলেন।
একটা রিকশা ডেকে ভটচাযকে তুলে দিতে রাত হয়ে গেল।
ভিতর বাড়িতে ফিরে আসবার সময়ে দেখলেন, শানুর ঘরে আলো জ্বলছে। বন্ধ দরজার সামনে একটু দাঁড়ালেন। ঘরটা নিঃশব্দ। আস্তে টোকা দিলেন দরজায়।
কে?
আমি।
ছোটকাকা?
হা।
শানু উঠে এসে দরজা খোলে। এ সময়টা দিগিনকে সবাই সমঝে চলে। কারণ প্রতি দিনই সন্ধের পর দিগিন নেশা করেন।
কিন্তু আজ তার নেশা হয়নি। যথেষ্ট পরিষ্কার আছে মাথা। চিন্তাশক্তি চমৎকার কাজ করছে।
শানু সপ্রশ্ন চোখে চেয়ে বলে, কিছু বলবে?
হুঁ। বলে দিগিন শানুর ঘরে ঢোকেন।
ঘরটা ভাল। বারো বাই বারো মাপের ঘর। ফোম রবারের গদিপাতা খাট, সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গদি-আঁটা চেয়ার, টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। শানু একটু শৌখিন মানুষ। অন্তত দশ জোড়া জুতো র্যাকে সাজানো। ওয়ার্ডরোবটা বেশ বড়সড়। তাতে প্রয়োজনের অনেক বেশি জামা কাপড় ঠাসা আছে।
সেক্রেটারিয়েটের সামনের চেয়ারটায় বসেন দিগিন। কথা বলেন না।
শানু বিছানায় বসে। চেয়ে থাকে।
শানু।
বলো।
ময়নার কাছে কেন গিয়েছিলি?
শানু স্মার্ট ছেলে। ঘাবড়াল না, একটু হাসল। বলল, তুমি চিরটাকাল কাকিমাকে বড় হেলাফেলা করেছ।
কাকিমা!
নয়?
দিগিন শ্বাস ফেললেন।