ভালই।
বন্নোরহো।
আমার হাতটা একটু দেখবেন ফকির সাহেব?
দিনের বেলা।
আগেও তো দেখেছেন।
জরুর।
আমার মরণ কবে?
ফকির সাহেব মজবুত ঈাত দেখিয়ে হাসলেন, বললেন, ওইসব জেনে কী হয় রে বেটা?
ময়না দাঁতে ঠোঁট কামড়ে একটু অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে দিগিনের দিকে। কথা বলে না।
দিগিন নীরবে চুরুট খেয়ে গেলেন কিছুক্ষণ। অন্যমনস্ক। একটা শ্বাস ফেলে বললেন, মানুষ জম্মায় কেন ফকির সাহেব?
খোদায় মালুম।
ফকির সাহেব উদাস উত্তর দেন। পানটা মজে এসেছে। নিমীলিত চোখে সেই স্বাদটা উপভোগ করতে করতে আস্তে করে বলেন, কৌন জানে। পয়দা বেফয়দা। তব ভি কুছ হ্যায় জরুর।
দিগিন হাসলেন। ফকির সাহেব তাত্ত্বিক নন, দার্শনিক কথাবার্তা আসে না, এমন অনেক কথা বলে ফেলেন যা ধর্মবিরুদ্ধ।
ষোলো বছরের সেই কিশোরীটি কত বড় হয়ে বুড়ো হতে চলল। কিন্তু কেন? আটান্ন বছর বয়সে এ সব প্রশ্ন নিতান্ত জরুরি বলে মনে হয়।
ফকির সাহেব একটা মস্ত বোতল পোঁটলা থেকে বের করে ময়নার হাতে দিলেন। বললেন, রাখ। এক মাহিনা আওর খেয়ে দেখ।
ওষুধটা বাচ্চা হওয়ার জন্য খায় ময়না। দিগিন জানেন। গত তিন-চার মাস ধরে খাচ্ছে।
ময়না বোতলটা নিয়ে এক বার দিগিনের দিকে তাকায়। চোখে একটা শুন্যভাব। বহু বছর ধরেই কি ময়না তার শূন্য চোখে চেয়ে আছে দিগিনের দিকে? দিগিন ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন না। একটা বাচ্চা ময়নাকে তিনি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা হয়তো ময়নারই দোষ। কারণ, ময়না তো একা দিগিনের সঙ্গ করেনি। কাজেই দিগিন নিজেকে দায়ি করতে পারেন না। ময়নাও বাচ্চার জন্য তেমন ভিখিরিপনা করেনি কখনও। আজকাল কান্নাকাটি করে। দিগিন বিরক্ত হন? ময়না আজকাল কেবল এক রকম ভাষাহীন চোখে চাইতে শিখেছে। দিগিন সেটা সহ্য করতে পারেন না। ময়নাকে তিনি যত দূর সম্ভব সুখে রেখেছেন, কখনও বিশ্বাসের ভঙ্গ হয়নি। বউয়ের চেয়ে কিছু কম তো নয়ই, বরং বেশি সুখেই আছে ময়না। মর্যাদা হয়তো নেই। কিন্তু মর্যাদা না পেলেই বা ঘুমের তরকারির দোকানের সেই অশিক্ষিত মেয়েটির কী যায় আসে। বরং উলটোদিক থেকে দেখলে ময়নাই দিগিনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। অবাধে মেলামেশা করেছে ছোকরাদের সঙ্গে। পয়সা রোজগারের জন্য নয়, কিংবা কেবল যৌনকাতরতার জন্যও নয়। সে বোধ হয় দিগিন নামের একটা পাথর ভাঙতে পারেনি বলেই পুরুষের বুক চিরে চিরে একটা নিরন্তর প্রবহমান ফরাকে খুঁজেছে। পায়নি। দিগিনের কাছ থেকে চলে যেতে চেয়েও যেতে পারেনি ময়না। সঁড়ের পোষা ময়না, যেতে পারে না। দিগিন ওর দিকে চেয়ে এক গিনিপিগকেই দেখতে পান। ময়নাকে তেমন শাসন কখনও করেননি দিগিন, কর্তৃত্ব নয়, দাবি-দাওয়াও নয়। হাওয়া-বাতাসের মতো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। কেউ কারও বাঁধা নয়। তবু কেন বাঁধা আছে ময়না তা ভাবেন দিগিন, অনেক চুরুট পুড়ে যায়, তবু সমাধান খুঁজে পাননি পঁচিশ বছর ধরে।
ময়না ভিতরবাড়িতে চোখের ইশারায় ডাকে। দিগিন উঠে যান। ধূপকাঠির গন্ধ ছাপিয়ে উঠেছে মাংস রান্নার গন্ধ। প্রেশার কুকারের তীব্র হুইসল বেজে উঠল।
ভিতরের ঘরে ময়না শোয়। একটা খাট পাতা, একটা ড্রেসিং টেবিল, কাঠের কাচবসানো আলমারি আলনা। দিগিন বিছানায় পা তুলে বসেন, ময়না মোড়া টেনে মুখখামুখি বসে।
ফকির সাহেবের ওষুধের টাকাটা দিয়ে দিতে হবে। ময়না বলে।
কত?
বিয়াল্লিশ টাকা। আমি দিয়ে দিচ্ছি আজ।
আমার কাছে আছে, দিয়ে দেব’খন যাওয়ার সময়।
ময়না চুপ করে থাকে একটুক্ষণ। হঠাৎ মুখ তুলে বলে, মরার কথা জিজ্ঞেস করছিলে কেন?
এমনই।
আমি জিজ্ঞেস করেছি।
কী?
বলেছি, বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
ও।
ফকির সাহেব বললেন যে, বাচ্চা হলে বাঁচতে ইচ্ছা করবে।
তাই নাকি।
ময়না দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, একা বেঁচে থাকা কত কষ্টের।
কষ্ট কী? দুনিয়ায় সবাই একা।
ময়না এ সব কথা ভাল বোঝে না। কিন্তু শুনলেই আজকাল ওর চোখ ভরে জল আসে। এখনও এল। চোখ মুছল নীরবে।
ময়না বলল, আমি কোথাও ঠিক চলে যাব।
দিগিন চুপ করে রইলেন।
ময়না বলে, শুনছ?
শুনেছি।
আমি কোথাও চলে যাব।
যেয়ো, আমি তো কখনও বারণ করিনি।
একটু তীব্রস্বরে ময়না বলে, কেন বারণ করোনি?
কেন করব?
ময়না কথা খুঁজে পায় না। আসলে সে বাঙালি মেয়েদের মতো কথার ওস্তাদ নয়। তার ওপর সে নানা রকম পাপ-বোধে ভোগে। সে জানে, দিগিনের প্রতি সে তেমন বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়নি।
প্রেশার কুকারের আর-একটা হুইসল বেজে ওঠে। শিউলির গন্ধের সঙ্গে মাংসের গন্ধ মিশে যায়। ময়নার ঝি কফি নিয়ে আসে।
দিগিন উঠে বসেন। বাঁ হাতের পাঁচ আঙুলের ওপর কাপসুদ্ধ প্লেটটা ধরে রেখে তিনি নীচে বসে ময়নার দিকে তাকান। দাঁড়ের ময়না। গিনিপিগ। বলেন, আজ সকালে শালুগাড়ার সিদ্ধাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম।
ময়না চেয়ে থাকে।
দিগিন কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন, সিদ্ধাই বলল, একজন ফরসা আর লম্বা মেয়েছেলে আমার খুব ক্ষতি করবে।
মেয়েছেলেটা কে?
তা বলেনি।
ফরসা আর লম্বা?
হ্যাঁ।
ময়না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সে কি আমি?
কী করে বলি?
কীরকম ক্ষতি?
তা-ও স্পষ্ট করে বলেনি।
ময়না চেয়ে থাকে। হঠাৎ মাথাটা নোয়ায়।
দিগিন হেসে বলেন, বোগাস। আসলে সবাই তোমাকে চেনে। আমাদের সম্পর্ক জানে, তাই ওসব বলে।
তুমি তো বিশ্বাস করো।