ছেড়ে ধরবটা কী?
সবই তোমার অদ্ভুত। শুধু শুটকি হলেই হবে নাকি?
না। ওই সঙ্গে একটু ফ্রায়েড রাইস মাংস আর মাছও কোরো। চাটের জন্য আলুর বড়া কোরো। মেটে চচ্চড়ি তো আছেই। ভটচায মদ-টদ খায় না, একটু চাখবে মাত্র। তাই খাবারটা দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যাবে।
বউদি চলে যাওয়ার আগে বলেন, টাকাটা কিন্তু একদম ভস্মে ঘি ঢালা হল। পারলে পাটিপত্রের দিন একটু কাটছাট কোরো।
তাই কখনও হয়। কথা হচ্ছে কথা। কিছু কাটছাট হবে না।
তোমার দাদা বলছিলেন এত টাকা বেরিয়ে গেল, শানুটাও লস দিচ্ছে, ব্যাবসাপত্রের না ক্ষতি হয়।
দিগিন একটা হাসি লুকোলেন, বললেন, ক্ষতি হবে তো বটেই। সোপস্টোনটা ডোবাবে, তবে ঠিকেদারি তো আছেই। চিন্তা কী?
বউদি একটু দাঁড়িয়ে থাকেন।
দিগিন বলেন, পুনির বিয়ে দেওয়ার পর আমি গরিব হয়ে যাব না ঠাকরোন, ভয় নেই।
বউদি শ্বাস ফেলে বলেন, তোমরাই বোঝো। আমি মেয়েমানুষ আমার এ সব কথায় থাকার কী?
মেয়েমানুষই তো কথায় থাকে। নইলে সংসারটা বাক্যহারা হয়ে যেত।
বউদি বলেন, তবু তো মেয়েমানুষের পদতল ছাড়া গতি নেই।
বউদি চলে যান। পুন্নি চা নিয়ে আসে। সন্ধে হয়। হিমালয় ঢেকে যায়। তিনধারিয়ার আলোব মালা জেগে ওঠে। ডাউহিলের ডগায় বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে। দার্জিলিঙের রাস্তায় ক্রমান্বয়ে মোড় নিয়ে যে-সব গাড়ি উঠছে বা নামছে তাদের হেডলাইট মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে।
সন্ধের মুখে দিগিন পোশাক পরে মোটর-সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়িতে বলে যান, ভটচায় এলে যেন বসানো হয়।
এই শরৎকালে শিলিগুড়ির মতো এমন সুন্দর জায়গা আর হয় না। আবহাওয়াটি বড় মনোরম। ঘাসে গাছপালার একটা ভেজা গন্ধ ওঠে। শিশির পড়ে, চারধাবে একটা নিঃশব্দ উৎসব লেগে যায়।
নিউ মার্কেটে আলো ঝলসানো দোকানপাট। হিলকার্ট রোড এখন কলকাতাকে টেক্কা দেয় আলোর বাহারে। চারধার আলোয় আলোময়।
দিগিন বাইকটা আস্তে চালিয়ে সেবক রোডের মোড় পেরিয়ে মহানন্দার পুলের কাছে এসে ট্যাঙ্কে পেট্রল ভরে নেন। পাম্পের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর বর্ধমান রোড ধরেন। ফাকা রাস্তা, ঝড়ের বেগে চলে আসেন ময়নার বাড়ির কাছে।
উঁচু রাস্তা থেকে একটা শুড়িপথ নেমে গেছে। বড় রাস্তায় বাইকটা সঁাড় করিয়ে অন্ধকার রাস্তাটা ধরে নেমে যান। ড্রেনের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব পাতা, সরপর, ঝুমকোলতার চালচিত্রওলা লোহার গেট। একটু ছোট বাগান। শিউলির গন্ধে ম ম করছে। কাঁচা মাটির গন্ধ পান। সেইসঙ্গে ধূপকাঠির একটা মিষ্টি গন্ধ।
ছোট হলেও বাড়িটা খারাপ না। দু’খানা ঘর, বাগান, কুয়ো, সবই আছে। বাছাই ভাল কাঠের দরজা-জানালা, বারান্দায় গ্রিল। একটা রাগী ভুটিয়া কুকুর আছে পাহারাদার। আর আছে একজন নেপালি ঝি। ময়না কিছু কষ্টে নেই। দিগিন মাঝে-মাঝে রাতে থেকেও যান। প্রায়দিনই দেখা করতে আসেন, যথেষ্ট টাকা-পয়সা দেন। ময়নার খারাপ থাকার কথা নয়। গত বাইশ-তেইশ বছর তো এভাবেই কেটেছে।
ধূপকাঠির গন্ধটা উন্মুখ হয়ে শুকতে শুকতে বারান্দায় উঠে আসতেই একটা অস্ফুট আহ্বাদের আওয়াজ করে কুকুরটা এসে লুটিয়ে পড়ে। বারংবার লাফ দিয়ে গায়ে ওঠে, প্রবল আবেগে পায়ে মুখ ঘষে। দিগিন তার মাথায় চাপড় মেরে আদর করেন। ঘরে টিউবলাইট জ্বলছে, নীল পরদা ফেলা। পুরুষকণ্ঠে ভিতর থেকে প্রশ্ন আসে, কে?
দিগিন উত্তর দেন না। কণ্ঠস্বরটা তিনি চেনেন। কাটিহারের ফকির সাহেব। মাঝেমধ্যে এদিকে আসেন।
বাইরের ঘরে একটা চৌকি আছে, গোটা দুই বেতের চেয়ার। চৌকিতে ফকির সাহেব বসে। লম্বা চুল, পরনে আলখাল্লা, চোখে সুর্মা মুখে পান। দাড়িটা ট্রিম করে কামাননা। চোখের দৃষ্টিতে একটা জ্বলজ্বলে তীব্রতা আছে। লোকে বলে ফকির সাহেবের বয়স একশো। সেটা বোধ হয় বাড়িয়ে বলা। দেখে পঞ্চাশের বেশি মনে হয় না।
দিগিন পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন।
ফকির সাহেব মৃদু হেসে বলেন, আও বেটা।
কখন এসেছেন?
বিকালে। রাতের গাড়িতে ফিরে যাচ্ছি, তো ভাবলাম ময়না বিটির সঙ্গে দেখা করে যাই।
আমাদের ওখানে গেলেন না তো?
যাব। ফি হপ্তা তো আসছিই।
ধূপকাঠির সুন্দর সুবাস আবার বুক ভরে টানেন দিগিন।
ময়নার ঝি উঁকি দিয়ে দেখে যায়। একটু পরেই ময়না আসে।
পরনে একটা চওড়া লালপাড়ের সাদা খোলের শাড়ি। বিয়াল্লিশ বছরের কিছু মেদ ও মেচেতা শরীর আর মুখকে শ্রীহীন করেছে বটে, কিন্তু এখনও দীর্ঘ শরীরে যথেষ্ট যৌবন রয়ে গেছে। মাথায় এলো খোঁপা, কপালে চন্দনের টিপ। নাকটা একটু ছোট হলেও ময়নার চোখ ছোট নয়। বেশ বড় বড় দুটি চোখ। মুখে কিছু ক্লান্তি, কিন্তু গাভীর্য। ময়না আজকাল নেপালি ভাষায় কখনও কথা বলে না। এমনকী সে তার ঝিয়ের সঙ্গে পর্যন্ত বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলে।
দিগিনকে দেখেই মুখটা অন্য ধারে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ফকির সাহেবের জন্য রান্না করছি, তুমিও খেয়ে যেয়ো।
দিগিন মাথা নাড়েন। বলেন, বাসায় আজ এক বন্ধু খাবে।
ও।–ময়না বলে।
দিগিন বেতের চেয়ারে বসেন। একটা চুরুট ধরান। বিশ্বের এমন কোনও মানুষ নেই যার সামনে দিগিন চুরুট না খান।
ফকির সাহেব তার পোঁটলা থেকে একটা কৌটো বের করে পান খেলেন, একগাদা দোক্তা মুখে দিয়ে ঝিম হয়ে বসে রইলেন একটু। পিক-টিক ফেলেন না। বার দুই-তিন হেঁচকি তুলে দোক্তার ধাক্কা সামলে নিয়ে বললেন, কী খবর-টবর?