- বইয়ের নামঃ ভুল সত্য
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. দিগিন বসে আছেন ইজিচেয়ারে
দিগিন বসে আছেন ইজিচেয়ারে। সামনে উঁচু টুলের ওপর পা দু’খানা ভোলা। দু’পায়ের পাতার ফাঁক দিয়ে শরৎকালীন পরিষ্কার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে একটু মেঘ। দিগিন দুপায়ের ফাঁক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে একটু বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন। তার বাঁ হাতের কাছে ছোট টেবিলের ওপর একটা দামি ট্রানজিস্টার রেডিয়ো। রেডিয়োর সামনে চায়ের খালি কাপ, কাপের পাশে মাদ্রাজি চুরুটের বাক্স, দেশলাই। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে রোদের ঠিকরে আসা আলো চোখে কট কট করে লাগে। পায়ের পাতা জড়ো করে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঢেকে দেন তিনি।
একটু আগে খবর হচ্ছিল রেডিয়োতে। তিনি খবরটায় মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করছিলেন। সংবাদ-পাঠক বলে যাচ্ছিল, গতকাল ভারত ও সোভিয়েট রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, উভয়পক্ষই একটি করে গোল দেওয়ায় খেলাটি অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। আজ আবার বৈঠক বসবে। ইত্যাদি। দিগিন তখন থেকেই নিজের ওপর এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর একটু বিরক্ত হয়ে আছেন। রেডিয়োটা বন্ধ করে দিলেন। অমনি নীচের তলা থেকে সরোজিনীর গান ভেসে আসে–এ প্রকাণ্ড জগতের মাঝে যত মিষ্টি যেথা আছে, সব দিলাম মা তোমার ভোগে, রোগ সারা মা, রোগ সারা…।
সরোজিনী, দিগিনের বোন। এ সব গান সরোজিনী নিজেই বানায়, সুব দেয় আর গায়। সরোজিনীর স্বামী আজ বছর দুই বিছানায় শোয়া। তার রাজ্যের অসুখ, মাঝে মাঝে ওঠা-হাঁটা করে, আবার বিছানা নেয় দু’দিন পর। সরোজিনী একটু পাগলি আছে। রামপ্রসাদি সুরে সারা দিনই গান গায়। ওর স্বামী হরিপদ মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে ধমকায়, চড়-চাপড়ও দেয়। কিন্তু তাতে সরোজিনীর কিছু পরিবর্তন হয় না।
দিগিন উভয়পক্ষের একটি করে গোল দেওয়ার রহস্যটা চোখ বুজে মনে মনে ভেদ করার চেষ্টা করছিলেন। কাল রাতে ভালই ঘুম হয়েছে তার। মাঝরাতে এক বার ঘুম ভেঙেছিল কুকুরের কান্না শুনে। মোদকের নেশায় ঘুম, সহজে ভাঙার নয়, তবু ভেঙেছিল। উঠে বাথরুম সেরে আবার শুতে যাওয়ার আগে কয়েক মিনিট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কাঠের খুঁটির ওপর টংগি ঘর। বারান্দা থেকে অনেক দূর দেখা যায়। খুব বেশি গাছপালা থাকায় কুকুরটাকে দেখা গেল না। আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে কৃষ্ণপক্ষের। মাঝরাতে এইসব চাদ-ফাদ দেখলে কুকুর-বিড়াল কাঁদবেই। এই সময়টায় ওদের বোধহয় পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। আবার শুলে শেষ রাতে তেমন ভাল ঘুম হবে না মনে করে দিগিন একটা ঘুমের বড়ি খানিকটা বিয়ার দিয়ে গিলে ফেলেন। বিয়ারের বোতলটা খুলে ফেলেছেন, তাই কী আর করেন, পুরো বোতলটাই সাফ করে শুয়ে পড়েন আবার। ঘুমের বড়িটা বেশ কড়া ধাতের, তার ওপর বিয়ার থাকায় কী একটা গোলমাল হয়ে গেল শরীরের মধ্যে। আজ সকাল পর্যন্ত মাঝে মধ্যে এই গোলমালটা টের পাচ্ছেন, কান’ শুনতে ‘ধান’ শুনছেন। ভারত আর সোভিয়েট রাশিয়ার মধ্যে তো ফুটবল খেলা হয়নি যে গোল হবে।
কাঠের সিড়িতে ঝোড়ো বেগে পায়ের শব্দ তুলে কে উঠে আসছে। শানু। শানু ছাড়া কারও এত তাড়া থাকে না। দিগিন ভারী বিরক্ত বোধ করে চোখ বুজে ঘুমের ভান করলেন। চুরুটটা জ্বলে জ্বলে ছোট হয়ে এসেছে, আঙুলে তাপ লাগছে।
শানু ঘরে ঢুকেই ডাকে, ছোটকাকা।
দিগিন উত্তর দেন না।
শানু কাছে আসে, ইজিচেয়ারের ওপর ঝুঁকে বলে, ও কাকা।
দিগিন চুরুটটা মুখে তুলে চোখ না খুলেই বলেন, হু।
ঘুমোচ্ছ?
শরীরটা ভাল নেই। কেন?
সোপাস্টোনের সেই ডিপোজিটটা ভুটান গভর্নমেন্ট আমাদের ইজারা দিতে রাজি হয়েছে, কিন্তু অনেক টাকা চাইছে।
কত?
পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। শান্তি আজ আবার যাবে কথাবার্তা বলতে।
দিগিন চোখ খোলেন না। বলেন, খামোখা।
এত খরচা করলাম, এখন পিছিয়ে যাব?
গেলেই ভাল। নইলে আরও টাকা ক্ষতি হবে। মোট কত খরচ হয়েছে?
হিসেব তো এখনও শেষ করিনি। খরচ তো এখনও হচ্ছে। তবে হাজার ত্রিশেক বেরিয়ে গেছে।
আরও যাবে।
লস হবে বলছ?
হবে।
কেন?
ডিপোজিট কতটা আছে পরীক্ষা করিয়েছ?
করিয়েছি।
কী বলে সার্ভেয়াররা?
কিছু বলতে পারছে না, ওপরের দিকের পাথরের কোয়ালিটি ভাল নয়। নীচের দিকে ভাল জিনিস থাকতে পারে। ঠিক কতটা ডিপোজিট আছে বলতে পারল না, বলা নাকি সম্ভব নয়।
হু।–দিগিন বলেন।
কী করব?
যা বলবার তা তো বহুকাল আগেই বলে দিয়েছি। এখনও অল্প ক্ষতির ওপর ছেড়ে দাও।
কিন্তু কলকাতায় যেনমুনা পাঠিয়েছিলাম তাতে অনেক ভাল খদ্দের ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে। দরও ভালই পাব।
দিগিন চোখ খুললেন। পায়ের পাতা সরে গেছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার গা থেকে ঠিকরে আসা রোদ আবার চোখে কটাশ করে লাগে। চোখটা বুজে ফেলে বলেন, যা ভাল বোঝো করো।
শানু অধৈর্য হয়ে কাঠের পাটাতনে জুতো ঠুকে বলে, তুমি একদম অ্যাডভাইস দিচ্ছ না। গত দু’ বছর চারটে লোককে দৈনিক চুক্তিতে লাগিয়ে রেখেছি। তারা দিনরাত খুঁজে খুঁজে বহু কষ্টে শেষ পর্যন্ত যাও বা ডিপোজিটটা খুঁজে পেল তাও এখন যদি কাজে লাগাতে না পারি তা হলে আমার। মনের তাবস্থাটা কী হয় এক বার ভেবে দেখেছ? কত টাকা জলে যাবে।
সোপস্টোন তো আর হিরে-জহরত নয়। ওর পিছনে দু’বছর অত টাকা ঢালা বোকামি হয়েছে। আগেই তোমার ভেবে দেখা উচিত ছিল।