কারণ একটাই, কৈশোরকাল। সেই বয়সটায় যাবতীয় স্মৃতি বড় মারাত্মক। তৃণার মধ্যে আর কিছু
থাক, ছিল সেই স্মৃতির সৌরভ তাকে ঘিরে। রোগা দুঃখী সেই কিশোরী মেয়েটাকে সে কবে ভুলে গিয়েছিল। দুরন্ত সময় তাকে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে তার কাছে। আর একটা কারণ চন্দনা নিজে।
তৃণার সুখের ঘর কেন ভাঙতে যাবে দেবাশিস? সে ভাল লোক ছিল না কোনওদিনই। তবু তার তো রুচি ছিল। সুযোগ পেলে সে যে-কোনও মেয়েকেই উপভোগ করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পাগল হয় না তো কারও জন্য! আর তৃণা পাগল করা মেয়েও নয়। যদিও তৃণার বয়স গড়িয়ে যায়নি, তবু তো ছেলেমেয়ের মা, গিন্নিবান্নি। এখন কি আর চোখে রং ছুড়ে দেয়ালা করে কেউ? ছবি-আঁকার ছলে তারা পরস্পরের দীর্ঘশ্বাস শুনেছিল। একজনের ছিল শচীন, অন্যজনের ছিল চন্দনা। তবু এও ঠিক, পৃথিবীতে কেউ কারও নয়।
দেবাশিস একটা জীবন যদি মেয়েবাজি না করত তবে তার চরিত্রে রাশ টানার অভ্যাস হত। কিংবা যদি চন্দনা হত মনের মতো বউ, তবে রাশ টানতে পারত চন্দনাই।
তা হল না। চন্দনা তাকে ঘরে টিকতে দিত না। কেবলই বলত— কোথায় ছবি আঁকা হচ্ছে, সব আমি জানি। তুমি মরে।
তখন সুন্দর ফ্ল্যাটটায় বাস করে তারা। লিফটে ওঠে নামে। গ্যারেজে গাড়ি। রবি তখন অজস্র কথা বলে। সংসারটা তখন সবে জমে উঠেছে।
একদিন ছুটির সকালে চন্দনা দেরি করে ঘুম থেকে উঠল। রবি ঘুমন্ত মাকে জ্বালাচ্ছিল খুব। উঠেই ঘা কতক দিল রবির পিঠে। যখন মারত তখন বড় নির্মমভাবে মারত, মায়া করত না, আবার একটু পরেই হামলে আদর করত। চন্দনার মাথায় একটু ছিট তো ছিলই।
সেদিন সকাল থেকেই চন্দনা বিগড়ে গেল।
দেবাশিস রোজকার মতো বসেছিল তার বাইরের ঘরে। সামনে খোলা স্টেটসম্যান, টুলের ওপর রাখা পা, পায়ের পাশে কফির কাপ। চন্দনা এসে স্টেটসম্যানটা কেড়ে নিল হাত থেকে। বলল, কী ভেবেছ তুমি?
কী ভাবব? ক্লান্ত দেবাশিস জবাব দেয়।
কত লোক অন্যায় করে ধরা পড়ে। তুমি কেন পড়ো না?
দেবাশিসের মনে পড়ে, সে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইটা হাত বাড়িয়ে নিয়েছিল। মনে মনে প্রার্থনা করেছিল–হে ঈশ্বর, চন্দনা কেন বেঁচে আছে? মুখে বলেছিল— চুপ করো।
চন্দনা চুপ করল না। অসম্ভব রেগে গেল। উলটোপালটা বকতে লাগল দেবাশিসকে। গালাগাল দিল। অজস্র। অবশেষে কাঁদল এবং কাঁদতে কাঁদতেই অসংলগ্ন বকতে লাগল একা তুমি আমার বাবাকে ঠকিয়েছ…আমার ছেলেকে ঠকিয়েছ তুমি আমাকে লুকিয়ে টাকা জমাও—
এ সব কথা বাস্তব সত্য নয়। কোনও মানেও হয় না। ডাক্তার ডাকা হল। ডাক্তার মত দিল–অজস্র মাথাধরার বড়ি, ঘুমের পিল, তার ওপর নিজের নির্ধারিত অসুখের জন্য নিজস্ব প্রেসক্রিপশানে খাওয়া ওষুধ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ— সব মিলেমিশে একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে।
সেই মানসিক ভারসাম্যহীনতা আর স্নায়ুর বিকার থেকে কোনও দিন সুস্থ হতে পারেনি চন্দনা। একদিন মরল। সাততলা থেকে সোজা লাফিয়ে পড়ল। তখন খুব ভোর। দেবাশিস আর রবি তখনও ওঠেনি।
দেবাশিস অবশ্য ছাড়া পেয়ে গেল কোর্ট থেকে। কিন্তু বেঁচে চন্দনা যতটা না ছিল, মরে তার চেয়ে ঢের বেশি ফিরে এল জীবনে। তাকে ভুলতেই তখন তৃণার পিপাসা ইচ্ছে করে খুঁচিয়ে তোলে দেবাশিস। যা অবৈধ তার মতো মাদক আর কী আছে!
বাবা! রবি ডাকে।
উঁ। দেবাশিস অন্যমনস্ক উত্তর দেয়।
চিড়িয়াখানায় আমরা কেন যাচ্ছি?
যাবে না?
অনেকবার গেছি তো। ভাল লাগেনি।
বিস্মিত দেবাশিস প্রশ্ন করে তবে কোথায় যাবে?
রবি লজ্জার সঙ্গে বলে, বেড়াতে ইচ্ছে করছে না।
তবে?
মণিমার কাছে চলো।
ও। দেবাশিস গাড়ি থামিয়ে একটু হাসে। তারপর মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলে, ঠিকই তো! সব ছুটির দিনে চিড়িয়াখানা কি আর ভাল লাগে!
ফিরে যাই চলো।
দেবাশিস মাথা নেড়ে বলে, পার্ক স্ট্রিটের কোন রেস্টুরেন্টে কী যেন খাবে বলেছিলে। খাবে না?
রবি তার চালাক হাসিটা হেসে বলে, পিপিং।
দেবাশিস বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, যাবে না?
যাব। বুড়োদা, নিকু, পন্টু, থাপি, ঝুমু আর নানির জন্য নিয়ে যাব। ওদের বলেছিলাম এই রবিবারে পিপিঙের খাবার খাওয়াব।
হ্যাঁ?
হ্যাঁ। রবি হাসে!
স্নিগ্ধ চোখে তার দিকে চেযে থাকে দেবাশিস। গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়।
বাবা।
উঁ।
মণিমা আমাকে খুব ভালবাসে।
জানি তো।
বুড়োদা, নিনকু, পন্টু সবাই।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। খুব ভালবাসে। গেলে ছাড়তেই চায় না। বলে, তুই আমাদের কাছে থাক।
ও!
আমি কেন ওদের কাছে থাকি না বাবা? মণিমা সকলের চেয়ে আমাকে বেশি ভালবাসে।
দেবাশিস সামান্য গম্ভীর হয়ে যায়। প্রথমটায় কথা বলতে পারে না। অনেকক্ষণ রবি নিঃশব্দে বাবার মুখখানা চেয়ে দেখে। মুখ দেখে বোধ হয় বুঝতে পারে, বাবা খুশি হয়নি।
পিছন থেকে চাঁপা বলে, তুমি বাড়িতে না থাকলে আমরা কার কাছে থাকব সোনাবাবু? বাবার যে তোমাকে ছাড়া ভীষণ মন খারাপ হয়।
অল্প কদিন থাকব। উত্তর দেয় রবি।
তারপর চলে আসবে? চাঁপা প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। আমিও তো বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারি না।
ময়দানের ভিতর দিয়ে গাড়ি উড়িয়ে দেয় দেবাশিস। এম ফর মাদার— কথাটা ভুলতে পারে না সে। তার ফ্ল্যাটবাড়িতে চন্দনার কোনও ফটো নেই। ইচ্ছে করেই চন্দনার সব ফটো সে তার লকারে চাবি দিয়ে রেখেছে, যাতে রবির চোখে না পড়ে। এই বয়সে মাতৃহীনের মায়ের কথা বেশি মনে পড়া বড় কষ্টকর। চন্দনার শাড়ি পোশাক, রূপটানের সব জিনিসপত্র, তার হাতের কাগজ কিংবা যত চিহ্ন ছিল সবই সরিয়ে দিয়েছে দেবাশিস, শাড়িগুলো বিলিয়ে দিয়েছে একে-ওকে। মানিকতলায় বোন ফুলিকে কয়েকটা দামি শাড়ি দিয়েছে, ও নিতে চায়নি তবু জোর করে দিয়েছিল দেবাশিস পড়ে থেকে নষ্ট হবে, তুই পর।