রবি বুটের শব্দ করে ছুটে আসে— আজ কেন বন্ধ?
একটু পরে খোলে। চলো, তোমাকে ক্যান্ডি কিনে দেব।
গাড়ির ভিতর থেকে চাঁপা ডেকে বলে, সোনাবাবু, তোমার জন্য আমি তো খাবার এনেছি, বাইরের জিনিস তবে কেন খাবে?
রবি তার বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছোট চোখে বাবাকে একটু দেখল। প্যান্ট-শার্ট-পরা দীর্ঘকায় বাবা, গলায় একটা সিল্কের ছাপা সাদা-কালো স্কার্ফ। একটু অন্যমনস্ক হয়ে বাবা জুতোর আগাটা তুলছে নামাচ্ছে, পকেটে হাত, ক্রু কোঁচকানো।
রবি ডান পা বাড়িয়ে ডান হাত মুঠো করে তুলে মুখ আড়াল করে দাঁড়াল। তারপর বাঁ হাত বাড়িয়ে বক্সিংয়ের স্ট্যান্স তৈরি করে এগিয়ে এসে বাঁ হাতটা বাবার পেটে চালিয়ে দিয়ে মুখে শব্দ করে–হোয়্যাম!
দেবাশিস কোলকুঁজো হয়ে সরে যায়। তারপর সেও ঘুরে দাঁড়ায়। অবিকল রবির মতো স্ট্যান্স নিয়ে এগিয়ে ভুয়ো ঘুসি মারে তার মুখে, রবি চট করে মুখটা সরিয়ে নিয়ে ঘুরে এগিয়ে আসে। নিঃশব্দে দুজন দুজনের দিকে চোখ রেখে চক্কর খায়, ঘুসি চালায়। চাঁপা গাড়ি থেকে মুখ বার করে স্মিত চোখে চেয়ে থাকে। পেট্রল ভরতে ভরতে পাম্পের অ্যাটেনডেন্ট লোকটা খুব হাসে।
দেবাশিস পেটে ঘুসি খেয়ে উবু হয়ে বসে পড়ে। সামনে তেজি বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রবি রেফারির মতো গুনতে থাকে— ওয়ান–টু–থ্রি–এইট-নাইন আউট! বলে শূন্যে আঙুল তুলে রবি।
দেবাশিস উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে বলে, কংগ্রাচুলেশন ফর জাস্ট বিয়িং দা নিউ হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন অব দা ওয়ার্ল্ড।
থ্যাংকস। হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়। মৃদু হাসে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, মে আই পুট এ টেলিফোন কল?
টু হুম?
মাই ফ্রেন্ড রঞ্জন।
গো এহেড।
দ্বিধাহীন গটমটে পায়ে রবি কাচের দরজা ঠেলে গিয়ে অফিস ঘরে ঢোকে। ফোন তুলে নেয় চালাক চতুর ভঙ্গিতে। দেবাশিস কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। শুনতে পায় রবি বলছে–হেল্লো, ইজ রঞ্জন। অ্যারাউন্ড? ইয়েস, রঞ্জন, দিস ইজ রবি— আউট ফর ফান–ফাস্ট টু জু, দেন টু মণিমা অ্যাট মানিকতলা-ইয়েস। ও নো, নট মহেশতলা, মানিকতলা–এম ফর–এম—ফর–
দরজার কাছ থেকে দেবাশিস প্রম্পট করে মীরাট।
চোখের কোণ দিয়ে দেবাশিসকে একবার দেখে নিয়ে মাথা নাড়ে রবি। ফোনে বলে…এম ফর মাদার। এ ফর–
এলাহাবাদ।
এলাহাবাদ। রবি প্রতিধ্বনি করে— অ্যান্ড এন ফর নিউ দিল্লি আই ফর ইন্ডিয়া।
দেবাশিস আস্তে আস্তে সরে আসে। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে। অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরায়। কথাটা কানে বিধে থাকে। এম ফর মাদার।
রবি যখন গাড়িতে এসে উঠল দেবাশিস একটু গম্ভীর। গাড়ি ছেড়ে চালাতে চালাতে বলে, তুমি ওভাবে স্পেলিং করছিলে কেন? ফোনে স্পেলিং করতে জায়গার নাম বলাই সুবিধা। মাদার কি কোনও জায়গা?
রবি একটু শিশু হাসি হাসে। বলে, জায়গাই তো।
জায়গা? মাদার আবার কী রকম জায়গা?
যেমন মাদারল্যান্ড।
দেবাশিস হাসে। তারপর শ্বাস ছেড়ে বলে, কিন্তু তুমি তো শুধু মাদার বললে, ল্যান্ড তো বলেনি।
লজ্জায় দু’হাতে চোখ ঢেকে একটু হাসে রবি। বলে, ভুল হয়েছিল।
গভীর একটা শ্বাস ফেলে দেবাশিস। রবি এখনও ভোলেনি, শুধু চেপে আছে। ওর ভিতরে হয়তো শুধু কষ্ট হয় মায়ের জন্য। কে জানে!
রবি সিটের ওপর হাঁটু মুড়ে বসেছে, মুখে আঙুল, দুলছে সিটের ওপর, চাঁপা সতর্ক গলায় বলে, পড়ে যাবে সোনাবাবু।
তোমার কেবল ভয়। বলে রবি ইচ্ছামতো দোল খায়। বলে, বাবা, আমি পিছনের সিটে বসব, দিদির কাছে?
যাও। দেবাশিস অন্যমনস্কভাবে বলে।
চাঁপা হাত বাড়িয়ে সিটের ওপর দিয়ে পিছনে টেনে নেয় রবিকে। সারাক্ষণ এরকমই করে রবি। একবার পিছনে যায়, একবার সামনে আসে। দুই হয়েছে খুব। দেবাশিস ওকে বকে না। মায়া হয়। ওর কি বড় মায়ের কথা মনে পড়ে?
দেবাশিস চন্দনাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। একটা সময় অনেক মেয়ের সঙ্গে ভাব ছিল তার। কাকে বিয়ে করবে তার কিছুই ঠিক ছিল না। চন্দনা ছিল সে সব মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে দুঃসাহসী আর কৌশলী। কুমারী অবস্থায় সে গর্ভে দেবাশিসের সন্তান নেয়। সেই অবস্থায় তাকে ফেলতে পারার সাধ্য দেবাশিসের হয়নি। চন্দনা সন্তান নষ্ট করতে দেয়নি। বলেছে—তুমি যদি বিয়ে না কর না করবে, ও আসুক কুমারী মায়ের কোলে।
সেটাই ছিল ওর কৌশল। দেবাশিস দু’মাসের গর্ভবতী চন্দনাকে বিয়ে করে আনল। যথাসময়ে রবি হল। ওর চার বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল চন্দনা।
বড় রাগি ছিল, ভেবেচিন্তে কিছু করত না।
তৃণার সঙ্গে দেবাশিসের সম্পর্কটা তখনও তৈরি হয়নি। তৃণা মাঝে-মধ্যে তাকে ডাকত ছবি আঁকার সুলুকসন্ধান জানতে। ওটা তখন তার বাই। জলরঙা ছবি আঁকতে গিয়ে তুলির জ্যাবড়া দাগ আর অসহিষ্ণু টান দিয়ে হয়রান হত। দেবাশিস তাকে তুলি চালাতে শিখিয়েছিল। দুটো রঙের মাঝখানে কীভাবে একটা রঙের সঙ্গে আর একটাকে মেলাতে হয় তার কৌশল অভ্যাস করাত। কিন্তু তাতে সময় নিত বড্ড বেশি। ব্যস্ত দেবাশিস তার অর্থকরী সময়টা যে নষ্ট করছে তা খেয়াল করত না। বড় ভাল লাগত।
তৃণা দেখতে খুব সুন্দর তা তো নয়, উপরন্তু বিবাহিতা, দুটি বড় বড় সন্তানের মা, এমন মেয়ের প্রতি আকর্ষণবোধ বড় অদ্ভুত দেবাশিসের পক্ষে। সে তো মেয়ে কিছু কম দেখেনি! তৃণার প্রতি এই দুর্বলতার তবে কারণ কী?