এ সব বছর-দুই আগেকার ঘটনা। বাড়ি রিনোভেট করা সদ্য শেষ হয়েছে তখন। নতুন হয়ে ওঠা বাড়ি ঝলমল করছে। তৃণা নিজের ঘরটা বেশি সাজায়নি। বেশি সাজানো ঘর তার পছন্দ নয়। তাতে তার মনের ধূসরতা নষ্ট হয়ে যায়। একটু সাদাসিধে নরম রং, আর আলো-হাওয়ার ঘরই তার ভাল লাগে। ভাল লাগে বিষণ্ণতা, একা থাকা, কবিতা।
দেবাশিস বলেছিল–তৃণা, ইনডেক তোমার জন্য কিছু করতে পারল না, একটা ব্যালকনি ছাড়া। আমার জন্য ইনডেকের কিছু করার নেই যে, আমি ডেকরেশন ভালবাসি না।
জানি। তুমি ক্লায়েন্ট হিসেবে যাচ্ছেতাই!
তৃণা হেসেছিল একটু।
বিপজ্জনক দেবাশিস দাশগুপ্ত বলল, কিন্তু মেয়ে হিসেবে ইউনিক। ঠিক বয়সটিতে ঠিক সময়ে তোমার সঙ্গে দেখা হলে বড় ভাল হত।
তৃণা ভয় পেয়ে বলে, ইস!
দুঃখের মুখ করে দেবাশিস বলে, আমার বউকে তো দেখেছ!
দেখলাম!
কেমন?
সুন্দর।
সুন্দর কিনা কে জিজ্ঞেস করেছে।
তবে?
স্বভাবের কথা বলছি।
বাঃ! তা কী করে বলব! একবার তো মোটে দেখেছি, বেশি কথাবার্তাও হয়নি। তবে স্বভাব খারাপ নয় তো!
ও টাকা আর স্ট্যাটাস ছাড়া কিছু বোঝে না, কোনও অনুভূতি নেই।
তাতে কী! সব মেয়েই ওরকম।
তুমি তো নও?
তৃণা বিষণ্ণ হয়ে বলেছে আমার কথা ছেড়ে দাও, বহুদিন রোগে ভুগে ভুগে আমি একটু অ্যাবনরমাল। আমি যে বেশি ভাবি, বেশি চুপ করে অন্যমনস্ক থাকি, কবিতা লিখি–এ সব আমার অস্বাভাবিক মন থেকে তৈরি হয়েছে। এ-বাড়ির কেউ আমাকে তাই পছন্দ করে না। ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত ইন্টেলেকচুয়াল মা বলে ক্ষ্যাপায়।
হবে।
শোনো, নিজের বউয়ের নিন্দে বাইরে কোরো না। ওটা রুচির পরিচয় নয়। যেমনটি পেয়েছ তেমনটির সঙ্গেই মানিয়ে চলো। তুমি বড় ছটফটে, চঞ্চল, বহু মেয়েকে চিঠি দিতে। অত মন তুলে নাও কী করে? তোমার যাকে-তাকে হুট করে ভাল লাগে, আবার হুট করে অপছন্দ হয়ে যায়। মনটা কোথাও একটু স্থির না করলে সারা জীবন ছুটে বেড়াতে হবে।
দেবাশিস মৃদুস্বরে হেসে বলে, তুমি এত কথা জানলে কী করে? আমি তো এখনও তেমন করে বউয়ের নিন্দে তোমার কাছে করিইনি। কী একটা কী একটা বলতে শুরু করেছিলাম। তুমি আগ বাড়িয়ে এককাঁড়ি কথা বললে।
ভারী লজ্জা পেয়ে গেল তৃণা। আসলে তার মন বড় বেশি কল্পনাপ্রবণ, একটু কিছু ঘটলেই তার পিছনে একটা বিশাল কার্যকারণ ভেবে নেওয়া তার স্বভাব। একবার আলমারি আর বাক্সের এক থোকা চাবি হারিয়ে ফেলেছিল সে, তার আগের দিন বাড়ির একটা দোখনো চাকর বিদেয় হয়েছে। চাবিটা চেনা জায়গায় খুঁজে না পেয়েই তৃণা ভাবতে বসল, এ নিশ্চয়ই সেই চাকরটার কাজ। জিনিসপত্র কিছু হাতাতে না পেরে চাবিটা নিয়ে পালিয়েছে। এরপর গাঁয়ের লোক জুটিয়ে একদিন ফাঁক বুঝে হাজির হবে। তৃণাকে মেরে রেখে ডাকাতি করে নিয়ে যাবে। কাল্পনিক ব্যাপারটাকে এতদূর গুরুত্ব দিয়ে সে প্রচার করেছিল যে শচীন বাধ্য হয়ে থানা-পুলিশ করে। চাকরটার গাঁয়ে পর্যন্ত পুলিশকে সজাগ করা হয়। কিন্তু তিনদিনের মাথায় বাথরুমে সাবানের খোপে চাবিটা তৃণাই খুঁজে পায়।
তার মন ওইরকমই। দেবাশিসকে সে প্রায় অকারণে বউয়ের ব্যাপারে দায়ি করেছে, দেবাশিস তার প্রেমে পড়ে গেছে গোছের চাপা একটা আশঙ্কা প্রকাশ করে ফেলেছে। লজ্জা পেয়ে সে বলে, আমার কেমন যেন মনে হয় তোমাকে! সাধারণ জীবনে তুমি খুশি নও।
দেবাশিস শ্বাস ফেলে বলেছে— তা ঠিকই। তবে খুব ভয়ের কিছু নেই।
যাই বলুক, ব্যাপারটা অত নিরাপদ ছিল না। এটা বোঝা যেতই দেবাশিস তার বউকে ভালবাসে না। অন্য দিকে তৃণাকে ভালবাসে না শচীন। কিংবা তৃণার কল্পনাপ্রবণ মন যেন সেইটাই ভেবে নেয়। মিথ্যে নয় যে তৃণার একথা ভাবতে ভালই লাগত যে শচীন তাকে ভালবাসে না। রেবা ভালবাসে না, মনু ভালবাসে না। সংসারে কেউ তাকে ভালবাসে না। সে একা, সে বড় দুঃখী। তার এই দুঃখের কোনও ভিত্তি থাক বা না থাক, একথা ভাবতে তার ভাল লাগত। এই দুঃখই তাকে সবচেয়ে বড় রোমান্টিক সুখটা দিত। দুঃখের চিন্তা বা চিন্তার দুঃখ কারও কারও কাছে বড় সুস্বাদু।
দেবাশিস সেই রন্ধ্রপথের সন্ধান পেয়েছিল। এ বাড়ির অনেক কাটা ভাঙা দুর্বল স্থান সে যেমন খুঁজে বের করে মেরামত করে ঢেকে সাজিয়ে দিয়ে গেছে তেমনি তৃণার সঠিক দুর্বলতাটুকু জেনে নিল সে অনায়াসে। কিন্তু সারিয়ে দিয়ে গেল না, বাড়িয়ে দিয়ে গেল।
তৃণার মন এমনই একটা কিছু চেয়েছিল। কোনও অঘটন, একটু পতন, একটু পাপ, সামান্য অপরাধবোধ উজ্জ্বলতম রঙের মতো স্পষ্ট করে দেয় জীবনকে। তার সেই দুর্বলতা দেবাশিস ফুলের মতো চয়ন করে নিজের বাটনহোল সাজাল লাল গোলাপের মতো। গোলাপটা লাল কেন? তৃণা ভেবে দেখেছে। লোকলজ্জার রাঙা আভায় তা লাল। কিছু পাপ কালো, কিছু পাপ রাঙা।
রাঙা শাড়িটা পরে নিল তৃণা। সাজল। ঘড়িতে এখনও বেশি বাজেনি, সময় আছে, থাকগে! তৃণা একটু ঘুরবে। তার পর বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়াবে।
০৩. পেট্রল পাম্পে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে
॥ তিন ॥
পেট্রল পাম্পে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে নেমে দেবাশিস আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল। হাই তুলতে তুলতে বলল, বিশ লিটার। বলে পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বের করে দিল।
রবি নেমে আইসক্রিমের স্টলটার কাছে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে চেঁচিয়ে বলে, বাবা, বন্ধ যে। কী আর করা যাবে!