চায়ের টেবিলে ওরা তখন বসেছে। মুখোমুখি দেবাশিস। তৃণা তার দিকে একপলক তাকিয়েই মুখ নিচু করে প্যাডে একটা স্টাডি রুমের ছবি এঁকে দেখাতে যাচ্ছিল, দেবাশিস একটু ভোম্বলের মতো তাকিয়ে থেকে বলে, তৃণা না?
তৃণা চমকে উঠেছিল। তাকিয়ে একটু কষ্টে চিনতে পেরেছিল দেবাশিসকে। ছেলেবেলার কথা, চিনতে তো কষ্ট হবেই।
শচীন বলে, চেনেন নাকি?
দেবাশিস বড় চোখে চেয়ে বলে, চেনা কঠিন বটে, তৃণার তো এতকাল বেঁচে থাকার কথাই নয়। যা ভুগত, ভেবেছিলাম মরেটরে গেছে বুঝি এতদিনে।
বটে! বলে শচীন হাসে।
বটেই তো! দেবাশিস অবাক হয়ে বলে, আমাদের মফস্বল শহরে পাশাপাশি বাস ছিল। ওর সবকিছু আমি জানি। ছেলেবেলায় দেখতুম, ও হয় বিছানায় পড়ে আছে, না হলে বড়জোর বারান্দা কি উঠোন পর্যন্ত এসে হাঁ করে অন্য খেলুড়িদের খেলা দেখছে। কখনও আমাশা, কখনও টাইফয়েড, কখনও নিউমোনিয়ায় যায়-যায় হয়ে যেত, আবার বেঁচেও থাকত টিকটিক করে। আমরা যখন ও শহর ছেড়ে চলে আসি তখন ও বোধ হয় ম্যালেরিয়ায় ভুগছে। আমার মা প্রায়ই দুঃখ করে বলত–মদনবাবুর মেজো মেয়েটা বাঁচলে হয়!’
তৃণা ভারী লজ্জা পেয়েছিল। সত্যিই সে ভুগত। বলল, আহা, সে তো ছেলেবেলায়।
তারপর তো আর তোমাকে দেখিনি। আমাকে চিনতে পারছ তো!
পারছি।
বলো তো কে!
রাজেন জ্যাঠার ছেলে।
দেবাশিস হঠাৎ হা হা করে হেসে বলে, রাজেন জ্যাঠা আবার কী! আমার বাবাকে ওই নামে কেউ চিনতই না। হাড়কেপ্পন ছিল বলে বাবার নাম সবাই দিয়েছিল কেপ্পন দাশগুপ্ত। সেটা সংক্ষেপ হয়ে হয়ে লোকে বলত কেপুবাবু। আমাদেরও ছেলেবেলায় কেউ কোন বাড়ির ছেলে জিজ্ঞেস করলে বলতুম— আমি কেপুবাবুর ছেলে।
তৃণার সবটাই মনে আছে। যারা রোগে ভোগে তাদের স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়। কেপুবাবুর ছেলে দেবাশিসকে সবাই চিনত ডানপিটে বলে। অমন হারামজাদা পাজি ছেলে বড় একটা দেখা যায় না। যত ছেলেবেলার কথা বলে উল্লেখ করেছিল দেবাশিস তত ছেলেমানুষ তখন তারা ছিল না। তখন রোগে-ভোগা তৃণার বয়স বছর তেরো, দেবাশিসের উনিশ কুড়ি। পাড়ার সব মেয়েকেই চিঠি দিত দেবাশিস, একমাত্র রোগজীর্ণ তৃণাকেই তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে চিঠি লেখেনি। বহুকাল পরে সেই উপেক্ষিত মেয়েটিকে পরিপূর্ণ ঘরসংসারের চালচিত্রের মধ্যে দেখে তার বিস্ময় আর শেষ হয় না!
বলল, মেয়েদের মুখ আমার ভীষণ মনে থাকে। নইলে তোমাকে চেনবার কথা নয়। বেঁচে আছ, তাই বিশ্বাস হতে চায় না। শচীনবাবুর ভাগ্যেই বোধ হয় বেঁচে আছ। ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন। তুমি বেঁচে না থাকলে শচীনবাবুকে আজও ব্যাচেলার থাকতে হত।
ঘটনাটা এরকম নিরীহভাবেই শুরু হয়েছিল। ইনডেক তাদের বাড়িটা ভেঙে মেরামত করছে, সাজিয়ে দিচ্ছে, ব্যালকনি বানাচ্ছে, জানলা বসাচ্ছে সেইসব তদারক করতে সপ্তাহে এক-আধবার আসত দেবাশিস। ভারী ব্যস্ত ভাবসাব, চটপটে কেজো মানুষের মতো বিদ্যুৎগতিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেত। গম্ভীর, পদমর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন দেবাশিস কোনওদিকে তাকাত না। দেখাশোনা শেষ করে কোনওদিন তৃণাকে ডেকে বলত— চলি। কোনওদিন বা দূরত্বসূচক হালকা গলায় বলত— চা খাওয়াবে নাকি কাদম্বিনী?
ও নামটা সে নিয়েছিল রবি ঠাকুরের জীবিত ও মৃত’ গল্প থেকে। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই। একদিন লাইনটা উদ্ধৃত করে দেবাশিস বলেছিল— তুমি হচ্ছ সেই মানুষ, মরোনি প্রমাণ করার জন্যেই বেঁচে আছ, কিন্তু কী জানি, বিশ্বাস হতে চায় না।
উল্টে তৃণা এলিয়টের লাইন বলেছে— আই অ্যাম ল্যাজারাস, কাম ফ্রম দি ডেড, কাম টু টেল ইউ অল, আই শ্যাল টেল ইউ অল
শচীন সবসময়ে বাড়ি থাকে না। রেবা আর মনু বড়লোকের ছেলেমেয়ে যেমন হয় তেমনি নিজেদের ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তৃণা সারাদিন একা। সে ক্যারাম খেলতে পারে, টেবিল-টেনিস খেলতে পারে, একটু আধটু ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। কিন্তু কোনওটাই তার সঙ্গী নয়! বরং কবিতার বই খুলে বসলে একরকম দূরের অবগাহন হয় তার। দেবাশিস নামকরা আটিস্ট, দুটো ফ্লপ ছবির পরিচালক, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী মহলে তার গভীর যোগাযোগ। তৃণার সেইটেই অবাক লাগত। ওই ফাজিল, মেয়েবাজ, এঁচোড়েপাকা ছেলেটির মধ্যে এ সব এল কোত্থেকে।
কখনও চা বা কফি খেতে বসে দেবাশিস বলত— তৃণা, তোমার সত্যিই কিছু বলার আছে?
তৃণা অবাক হয়ে বলেছে–কী বলার থাকবে?
ওই যে বলো, আই শ্যাল টেল ইউ অল।
যাঃ, ও তো কোটেশন।
মানুষ যখন কিছু উদ্ধৃত করে তখন তার সাবকনশাসে একটা উদ্দেশ্য থাকে।
আমার কিছু নেই।
দেবাশিস গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবত।
রেখার জন্মদিনে সেবার দেবাশিসকে সস্ত্রীক নেমন্তন্ন করেছিল তৃণা। দেবাশিসের বউ এল তার সঙ্গে। মানানসই বউ। ভাল গড়ন, লম্বাটে চেহারা। রং কালো, মুখশ্রী খারাপ নয়। কিন্তু সারাক্ষণ কেবল টাকা আর গয়না আর গাড়ি আর বাড়ির গল্প করল। বুদ্ধি কম, নইলে বোঝা উচিত ছিল যে বাড়িতে বসে বড়লোকি গল্প করছে সে বাড়ি তাদের একশোগুণ ধনী। হঠাৎ যারা বড়লোক হয় তারা টাকা দিয়ে কী করবে বুঝতে পারে না, হা-ঘরের মতো বাজার ঘুরে রাজ্যের জিনিস কিনে ঘরে জঙ্গল বানায়, বনেদি বড়লোকেরা ওরকমভাবে টাকা ছিটোয় না, গরম দেখায় না। দেবাশিসের বউ চন্দনা টাকায় অন্ধ হয়ে চোখের সামনে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। মুখে বেড়ালের মতো একটা আহ্লাদি ভাব, চোখে সম্মোহন, বার বার স্বামীকে ধমক দিচ্ছিল। অনেক অতিথি ছিল বাড়িতে। ওদের সঙ্গে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে পারেনি তৃণা। অল্প যেটুকু সময় কাটিয়েছিল তাতেই তার বড় লজ্জা করেছিল। দেবাশিসের বউ বস্তুজগৎ ছাড়া আর নিজের সুখদুঃখ ছাড়া কোনও খবর রাখে না।