কী করব?
সাবধান হওয়া ভাল। যা কর ছেলেকে সাক্ষী রেখে কোরো না।
তিনু, তুমি কিন্তু এতটা গেরস্ত মেয়ে ছিলে না, দিনদিন কী হয়ে যাচ্ছ?
বয়স হচ্ছে।
ও সব আমি বুঝি না। গত সাতদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি।
মিথ্যুক।
কী বলছ?
বলছি তুমি মিথ্যুক। তৃণা হাসে।
কেন?
পরশুদিনও তুমি সন্ধের পর গাড়ি পার্ক করে রেখেছিলে রাস্তায়, যেখান থেকে আমার শোয়ার ঘরের জানলা দেখা যায়।
বাঁ হাতে বুক চেপে ধরে দেবাশিস, শ্বাসকষ্ট। হৃৎস্পন্দন হারিয়ে যায় একটা…দুটো… গভীর একটা খাস টানে সে। বুকে বাতাসের তুফান টেনে নেয়।
দেবাশিস আস্তে করে বলে, কী করে বুঝলে যে আমি।
তোমাকে যে আমি সবচেয়ে বেশি টের পাই।
গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখেছ।
না। আবছা গাড়িটা দেখেছি। আর দেখেছি ড্রাইভিং সিটে একটা সিগারেট আর দুটো চোখ জ্বলছে।
যাঃ।
আমি জানি দেব, সে তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।
দেবাশিস দাঁত টিপে চোখ বুজে লজ্জাটাকে চেপে ধরে মনের মধ্যে। গলার স্বর কেমন অন্য মানুষের মতো হয়ে যায়, সে বলে, তুমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না।
জানবে কী করে! তৃণা হাসে তোমাকে যে না চেনে সে কী করে জানবে রাস্তায় কার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কে বসে আছে ড্রাইভিং সিটে একা ভূতের মতো! আমি ছাড়া এত মাথাব্যথা আর কার?
তুমি অনেকক্ষণ বড় জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলে। পিছনে ঘরের আলো, তাই তোমার মুখ দেখতে পাইনি। যদি জানতাম যে তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ।
তা হলে কী করতে?
তা হলে তক্ষুনি রাস্তায় নেমে ছক্করবাজি নাচ নেচে নিতাম।
দেব, বয়স বাড়ছে।
দেবাশিস তৎক্ষণাৎ বলে, পাগলামিও।
বুঝলাম। কিন্তু কেন? ওরকম কাঙালের মতো আমার বাড়ির পাশে বসে থাকবার মতো কী আছে? নতুন তো নয়।
দেবাশিস ঠিক উত্তরটা খুঁজে পায় না। রক্ত কলরোল তোলে। বুকে আছড়ে পড়ে অন্ধ জলোচ্ছাস। সে বলে, তিনু, আমি বড় কাঙাল।
তৃণা একটু খাস ফেলে। কিছু বলে না।
দেবাশিস বলে, শুনছ।
কী?
আমি বড় কাঙাল।
কাঙাল কি না জানি না, তবে বাঙাল বটে।
তার মানে?
বাঙাল মানে বোকা। বুঝেছ?
তাই বা কেন?
রবি কোথায়? তোমার এ সব পাগলামির কথা তার কানে যাচ্ছে না তো?
কানে গেলেই কী! ও বাচ্চা ছেলে, বুঝবে না।
তৃণা একটা মৃদু হাসি হেসে বলে, তুমি বাচ্চাদের কিছু জানো না। ওরা সব আজকাল পাকা বিন্দু হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বাচ্চারা কিন্তু সব টের পায়।
দেবাশিস একটু হতাশার গলায় বলে, শোনো, রবির জন্য চিন্তার কিছু নেই। চিন্তা করে লাভও নেই। যদি টের পায় তো পাক। আগে বলল, তোমার সঙ্গে দেখা হবে কি না।
তৃণা মৃদুস্বরে বলে, কোথায়?
তুমি যেখানে বলবে।
আমার লজ্জা করে। তোমার সঙ্গে যে তোমার ছেলে থাকবে।
ও তোমায় চেনে না নাকি! এ সব নতুন ডেভেলপমেন্ট তোমার কবে থেকে মনে হচ্ছে?
রবি বড় হচ্ছে তাই ভয় পাই। বুঝতে শিখছে।
ভয় পেয়ো না। গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি। ঘন্টা খানেক চিড়িয়াখানা আর রেস্টুরেন্টে কাটাব। দুপুরে আমার বোনের বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ। অবশ্য একা রবিরই নিমন্ত্রণ, ওদের বাড়িতে যে আমি খুব জনপ্রিয় নই তা তো জানোই, রবিকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আমি ফ্রি।
তার মানে এগারোটা কি বারোটা হবে বেলা। আমি কি তোমার মতো স্বাধীন দেব? দুপুরে সকলের খাওয়ার সময়ে বাইরে থাকলে লোকে বলবে কী?
তা হলে চিড়িয়াখানা বা রেস্টুরেন্টে এসো।
তা হলে রবিকে চোখ এড়ানো যাবে না।
উঃ। তুমি যে কী গোলমাল পাকাও না।
তৃণা হেসে বলে, আচ্ছা না হয় দুপুরের প্রোগ্রামই থাকল। কোথায় দেখা হবে।
তুমি ফাঁড়ির কাছে বাসস্টপে থেকো।
দেবাশিস চোখের কোণ দিয়ে দেখে রবি এসে দাঁড়িয়েছে পর্দা সরিয়ে দরজার চৌকাঠে। স্ট্রেচলনের একটা হালকা নীল রঙের প্যান্ট আর দুধ-সাদা একটা টি-শার্ট পরনে, বুকের কাছে বাঁ ধারে মনোগ্রাম করা ওর নামের আদ্য অক্ষর। মাথায় থোপা থোপা চুলের ঘুরলি। একটু হাসি ছিল মুখে। সেটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে এখন।
তা হলে? দেবাশিস ফোনে বলে।
আচ্ছা ছাড়লাম।
সো লং।
ফোনটা রেখে দেয় সে।
হাসিটা আর রবির মুখে নেই, মিলিয়ে গেছে, চেয়ে আছে বাবার দিকে। চোখে চোখে পড়তেই মুখটা সরিয়ে নিল।
দেবাশিস ছেলের দিকে চেয়ে থাকে। বুকের মধ্যে ঝড় থেমেছে, ঢেউ কমে এল, শুধু অবসাদ। টেনশনের পর এমনটা হয়, মুখে একটু সহজ হাসি ফুটিয়ে তোলা এখন বেশ শক্ত, টানাপোড়েন এখনও তো শেষ হয়নি। তৃণার সঙ্গে দুপুরে দেখা হবে, ফাঁড়ির কাছের বাসস্টপে। তার স্নায়ুর ভিতরে এখনও একটা তৃষ্ণার্ত উচাটন ভাব। দেখা হবে, পিপাসা বাড়বে, তবু এক সমুদ্রের তফাত থেকে যাবে সারা জীবন তৃণার সঙ্গে তার।
রবি মুখ তুলতে দেবাশিস ক্লিষ্ট একরকম হাসি হাসে। রবি কি সব বোঝে। বুকের মধ্যে একটা ভয় আচমকা হৃদ্যন্ত্রকে চেপে ধরে তার।
চতুর ভঙ্গিতে দেবাশিস এক পা এগিয়ে হাত বাড়িয়ে বলে, দিস ইজ দেবাশিস দাশগুপ্ত।
বাড়ানো হাতখানা রবি ধরে শেকহ্যান্ড করতে করতে বলে, দিস ইজ নবীন দাশগুপ্ত, প্লিজড টু মিট ইউ।
রবির পিছনে চাঁপা দাঁড়িয়ে। পরিষ্কার শাড়ি পরেছে, চুল আঁচড়েছে। দেবাশিসের চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ভারী নরম সুরে বলে, বাবা, আমি কি সোনাবাবুর সঙ্গে যাব?
দেবাশিস অবাক হয়ে বলে, কোথায়?
চাঁপা লাজুক গলায় বলে, সোনাবাবু ছাড়ছে না, কেবল সঙ্গে যেতে বলছে!