তৃণা উঠল। চাকরের মুখের মা ডাকটা কানে বাজতে থাকে। বাথরুম সেরে এসে খাওয়ার টেবিলে চলে গেল সে। রাতের খাওয়ার সময়টায় সে প্রায়ই থাকে। নিয়ম। না থাকলেও ক্ষতি নেই, তবু নিয়ম।
খাওয়ার টেবিলে আজ সবাই খুব হাসি খুশি।
শচীন ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প বলছে। কথামৃতের গল্প। সবাই শুনছে। এ সব গল্পের মধ্যে অবশ্য তৃণাকে ওরা রাখে না। টেবিলের একধারে তৃণা চুপ করে বসে থাকে। টেবিলে সাজানো খাবার। যে যার প্লেটে তুলে নিয়ে খায়।
শচীন গল্পের শেষে বলল, জাপানের চালানটা এলে দেখবি। বামন গাছের এমন একটা বাগান করব।
আমাদের স্কুলে ইকেবানা শেখায়। রেবা বলে।
মনু বলল, সে আবার কী?
ফুলদানি সাজানো। খুব মজার। জাপানিরা স্বর্গ, মানুষ আর পৃথিবী এই প্যাটার্নে ফুল সাজায়। অদ্ভুত।
মনু বলে, জাপানিরা খুব প্রগ্রেসিভ। না বাবা?
প্রগ্রেসিভ! শচীন বলে, তা ছাড়া ওদের মতো মাথা কারও নেই। শুধু দোষের মধ্যে বড্ড সেন্টিমেন্টাল, একটুতেই সুইসাইড করে।
হারিকিরি। রেবা বলে।
হারিকিরি নয়। মনু বলে, হারাকিরি!
এইরকম সব কথা।
রান্নার লোকটা নিঃশব্দে ঘরের একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। রোজই থাকে! চমৎকার রাঁধে সে। কোনও ভুল হয় না।
আজ হঠাৎ চাইনিজ চপ সুয়ের একচামচ মুখে তুলেই রেবা চেঁচিয়ে বলে, চিত্ত, আজ এটাতে নুন দাওনি!
চিত্ত শশব্যস্তে–দিয়েছিলাম তো!
দাওনি। রেবা জোর গলায় বলে।
মনু একটু মুখে দিয়ে বলে, দিয়েছে। তবে কম হয়েছে।
শচীন বলল, টেস্ট কিন্তু দারুণ।
রেবা বিরক্ত হয়ে তার বাবার দিকে নুনের কৌটো এগিয়ে দেয়। কী ভেবে নিজেই নুন ছড়িয়ে দেয়। মনুর প্লেটেও দেয়।
তারপরই হঠাৎ তৃণার দিকে ফিরে বলে, মা, তোমাকে… ওঃ, তুমি তো এখনও খাওয়া শুরুই করোনি!
তৃণা ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে রেবা তাকে মা বলে ডাকছে। গত এক বছর একবারও ডাকেনি। তার কানমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে রক্তের জোয়ারে। বুক ভেসে যায়, হৃদয় ক্ষরিত হয়। বহুকাল বাদে স্তনের ভিতরে যেন ঠেলে আসে দুধ। অস্থির তৃণা চেয়ারের হাত চেপে ধরে। আনন্দ! আনন্দ! এত আনন্দ সে বুঝি জীবনে একবারও আর ভোগ করেনি। কেউ তার অবস্থা লক্ষ করছে না! ভাগ্যিস! শচীন ওদের বিদেশের একটা অভিজ্ঞতার গল্প করছে। ওরা কি জানে তৃণার ভিতরে একটা ট্যাপ কে যেন খুলে দিয়েছে! অবিরল নিঝরিণী বয়ে চলেছে তার শরীর দিয়ে। সেই স্রোত তার চারধারে সব কিছুকেই অবগাহন করাচ্ছে, শব্দটা কান পেতে শোনে তৃণা স্রোতের শব্দ।
পরদিন সকালে তৃণা কবিতার খাতা নিয়ে বসল।
আজও দেবাশিস আসবে। বিকেলবেলায়। বাসস্টপে।
০৯. সারা বাড়িতে আজ চন্দনার ভূত
॥ নয় ॥
সারা বাড়িতে আজ চন্দনার ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দেবাশিস একা সিগারেট খেল অনেকক্ষণ। আবার উঠল। জানালাটা দিয়ে ঝুঁকে পড়ল রাস্তার ওপর। বহু নীচে ফুটপাথ! মাঝখানে নিরালম্ব শূন্যতা! চন্দনা কী করে অত সাহস পেল?
দেবাশিস তো পারে না। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কলকাতা। ঘর সাজাবে বলে, ফুলশয্যা বলে ফুল এনেছিল সে। এখন এই নিশুতরাতে সেই গন্ধ ছড়াচ্ছে। কী গভীর সুগন্ধ! সুগন্ধটা টেনে রাখে তাকে।
দেবাশিস প্রেতের মতো একা এসে বসে সোফায়। মাথার চুল মুঠো করে ধরে! রবি নেই। রবি এখন মণিমার বুক ঘেঁষে অঘোরে ঘুমোচ্ছ!
একবার রবির ঘরে এল ‘দেবাশিস। রোজ রাতেই আসে। ঘোট ঘোট শ্বাস ফেলে রবি ঘুমোয়। চেয়ে দেখে। পাশ ফিরিয়ে দিয়ে যায়। আজ রবির ছোট্ট বিছানাটা ফাঁকা পড়ে আছে।
আজকের দিনটা কেমন যেন! হাতের মুঠো থেকে পয়সা হারিয়ে গেলে শিশু যেমন অবাক তেমনি লাগছিল দেবাশিসের।
রবি নেই! তৃণা নেই।
ভালই। এ একরকমের ভালই।
প্রেতের মতো ভয়ংকর শুকনো একটা হাসি হাসল দেবাশিস।
বুকে এখনও যেন রবির খেলনা পিস্তলের মিথ্যে গুলি বিধে আছে। বড় যন্ত্রণা।
অস্ফুট শব্দ করল দেবাশিস; যন্ত্রণাটার অর্থ বুঝতে পারল না।
কালই ইনডেক-এর একটা মস্ত কন্ট্রাক্ট শুরু হচ্ছে আসানসোলে। সকালের গাড়িতেই চলে যেতে হবে।
দেবাশিস শুল। ঘুম আসছে ভারী ক্লান্তির মতো। ঘুমচোখে মনে পড়ল, ভুল করে কাল বিকেলে বাসস্টপে আসতে বলেছে তৃণাকে। এসে ফিরে যাবে।
ফোন করবে? থাকগে! আজ একটা ভুলের দিন গেল। আজ আর ভুলগুলোকে ঠিক করার চেষ্টা করবে না। থাক। ভুলের দিনটা কেটে যাক।