দেবাশিস এগিয়ে তৃণার হাত ধরে এনে সোফায় বসায় যত্ন করে। নিজে তার পাশে বসে। হাতখানা। ধরে থেকে বলে, তোমার নাড়ি বেশ দুর্বল।
তৃণা ঘাড় এলিয়ে রেখে বলল, আজকের দিনটা কেমন যেন ভাল নয়। বিশ্রী দিন।
উদ্বেগে দেবাশিস ঝুঁকে বলে, কেন তৃণা?
দেবাশিসের কাছে আসা মুখখানা হাত তুলে আটকায় তৃণা। বলে, এক একটা দিন আসে সকাল থেকেই কেবল সব কাজ ভুল হতে থাকে। যেন ভূতে পায় মানুষটাকে।
কীরকম?
দেখ না, কোনও দিনই তো আজকাল রেবার বা মনুর ঘরে যাই না! আজ যেন ভূতে পেল। গেলাম। রেবা হঠাৎ এসে পড়ল, চোরের মতো ধরা পড়ে গেলাম; কী বিশ্রী রকমের ব্যবহার যে করল ও।
তুমি রেবাকে বড্ড ভালবাসো তৃণা।
ভীষণ ভালবাসি। সেইজন্যই তো ও আমার বুক ভেঙে দেয়।
সাতটা কিন্তু বেজে গেছে তৃণা।
দাঁড়াও না। আজ কি একটা সাধারণ দিন। সকাল থেকেই সব অনিয়ম চলছে। অদ্ভুত দিনটি আজ। ঘড়ি-টড়ি দেখো না।
দেখব না। বলো।
তারপর মনু। ওকে বলেছিলাম, ঘরে পৌঁছে দে, শরীরটা ভাল না। তো ছেলে আমাকে জাপটে কোলে তুলে নিল। এমনিতে কথাও বলে না। তবে কেন আজ…? তারপর শচীনবাবু। সেও আজ অন্যরকম। রুমাল কুড়িয়ে দিল…অনেক কথা বলল…
শোনো তৃণা, শচীনকে ফোনটা কিন্তু করা হয়নি।
পরে কোরো।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা তোমার খোঁজ করছে। ওদের কেন অযথা ভাবতে দিচ্ছ?
ভাবুক। একটু ভাবুক। কোনওদিন তো ভাবে না।
না তৃণা। তুমি ভুল করছ। যা করছ তা আরও বলিষ্ঠভাবে করো। চুরি তো করোনি।
তৃণা দেবাশিসের হাতটা ধরে বলল, আঃ! তোমার কেবল ভয়। শোনো না।
দেবাশিস শ্বাস ছেড়ে বলল, বলো।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই আমাকে আজ ভূতে পেল।
সে কী রকম?
ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। ঠিক যেন নিশি-পাওয়া মানুষের মতো একটা ছেলে মোটরসাইকেল চালিয়ে গেল, সেই শব্দে চেতনা হয়। তারপরও ফের ভুল। একটা ট্যাক্সিওলা নিয়ে গেল দেশপ্রিয় পার্কে। তাকে ডিরেকশন দিতে মনে ছিল না, রাস্তাটাও খেয়াল করিনি। তাই মনে হচ্ছে, আজকের দিনটা খুব অদ্ভুত।
কী বলতে চাও তৃণা?
তৃণা অন্ধকারেই মুখ ফেরাল তার দিকে। বলল, এক একটা দিন আসে, ভুল দিয়ে শুরু হয়। ভুলে শেষ হয়। ভুতুড়ে দিন।
তৃণা, ভুল দিয়ে শেষ হচ্ছে না। তুমি বড্ড সেকেলে।
দেব। শোনো, আমি শুধু একটাই ঠিক কাজ করেছি আজ।
কী?
শচীনকে বলে আসিনি।
বলে আসা উচিত ছিল। এটাই ভুল করেছ।
তৃণা মাথা নেড়ে বলে, না। বলে আসলেই ভুল করতাম।
দেবাশিস অধৈর্যের গলায় বলে, আমি এক্ষুনি ফের শচীনকে ফোন করছি।
বলেই বাধা না মেনে উঠে গেল দেবাশিস। ফোনের ওপর ঝুঁকে পড়ে অল্প আলোয় ঠাহর করে করে আস্তে আস্তে ডায়াল ঘোরাতে থাকে।
ফোনটা কানে তুলে অপেক্ষা করছে। তৃণা উঠে এল কাছে, ফোনটা নিয়ে নিল হাত থেকে। রেখে দিতে যাচ্ছিল, শুনল ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলার স্বর বলে উঠল, হ্যালো।
রেবা বোধ হয়! তৃণা তাই ফোনটা কানে লাগায়।
ওপাশে চঞ্চল ও ধৈর্যহীন গলায় রেবা বলছে, কে? হ্যালো! কে?
উত্তর দিতে সাহস হল না তৃণার। কেবল খানিকক্ষণ শুনল!
রেবা চেঁচিয়ে তার বাবাকে ডাকছে, বাপি, দেখো, ফোনটা বাজল, কেউ সাড়া দিচ্ছে না এখন।
পরমুহূর্তেই শচীনের গলা–হ্যালো।
তৃণা মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে রাখল।
শচীন রেবাকে ডেকে বলল, গোস্ট কল। আজকাল টেলিফোনে যত গোলমাল।
বলেই আবার, শেষবারের মতো বলল, হ্যালো! কে?
কেউ না। আমি কেউ না। এ কথা মনে মনে বলে তৃণা।
দেবাশিস কানের কাছে মুখ নামিয়ে নরম গলায় বলে, তৃণা, বলতে পারলে না?
শচীন ফোন রেখে দিল।
তৃণা মাথা নেড়ে বলল, না। আজকের দিনটা থাক। দিনটা ভাল নয় দেব।
খুব ভাল দিন তৃণা।
না দেব, আজ কোনও ডিসিশন নেওয়া ঠিক হবে না।
তা হলে কী করবে তৃণা?
তা হলে…
তৃণা ভ্রূ কুঁচকে ভাবতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে ভাবে।
দেবাশিস অপেক্ষা করে উগ্র আগ্রহে।
০৮. গাড়ি থামল গাড়ি চলে গেল
॥ আট ॥
গাড়ি থামল। গাড়ি চলে গেল।
নিজের বাড়ির সামনে একা দাঁড়িয়ে তৃণা। বুকে একটা খাঁ খাঁ আকাশ। সেই আকাশে নানা ভয়ের শকুন উড়ছে।
রাত আটটা বেজে গেছে। তবু তেমন রাত হয়নি। এখনও স্বচ্ছন্দে বাড়িতে ঢোকা যায়। কেউ ফিরেও তাকাবে না সে জন্য। দেবাশিসের গাড়িটা গড়িয়াহাটা রোডের মুখে গিয়ে বাঁ ধারে মোড় নিল।
তৃণা বাড়ির গেট দিয়ে ধীর পায়ে ঢোকে। মস্ত আলো জ্বলছে বাইরে। ছোট বাগানটার গাছপালার ওপর আলো পড়েছে। হাওয়া দিচ্ছে। চাঁদ উঠেছে। ফুলের গন্ধ মুঠো মুঠো ছড়াচ্ছে বাতাস।
আজকের দিনটা দেবাশিসের কাছে ভিক্ষে নিল তৃণা। আজ দিনটা ভাল নয়। এই ভুতুড়ে দিনে এতবড় একটা সাহসের কাজ করতে তার ইচ্ছে করল না। আজকের দিনটি কেটে গেলে এরপর যে কোনওদিন সে চলে যাবে। কেন থাকবে এখানে? কেন থাকবে।
আস্তে ধীরে সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল। বাঁ ধারের ঘরটায় টেবিল-টেনিস খেলছে রেবা আর তার এক মাদ্রাজি মেয়ে-বন্ধু সরস্বতী। ছোটাছুটি করছে। হাসছে। তাকে কেউ দেখল না।
শচীনের কাকাতুয়াটা চেচিয়ে বলল, চোর এসেছে। চোর এসেছে। শচীন! শচীন!
তৃণা ধীরে তার ঘরে এসে দাঁড়ায়। আলো জ্বালে না। চুপ করে বিছানায় বসে থাকে কিছুক্ষণ, এবং বসে থাকতে থাকতেই টের পায, বুকে আকাশ, আকাশে শকুন। মনটা ভাল থাকলে এই নিয়ে একটাকবিতা লিখত সে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তৃণা। অলক্ষ্যে এবং নিজের অজান্তে চাকর এসে ডাকল— মা, খাবেন না? সবাই বসে আছে।