ওকে ফোনটা দে।
একটু পরেই রবির গলা শোনা গেল–বাবা।
বলল। ভারী স্নিগ্ধ হয়ে গেল দেবাশিসের গলা।
আমরা বেড়াচ্ছি।
কোথায়?
ট্যাক্সি করে বেরিয়েছি। এখন আছি শ্যামবাজারে।
সঙ্গে কে আছে?
মণিমা, পিসেমশাই, নিন্কু…
এনজয় ম্যান।
বাবা, আমার বই, জামা, প্যান্ট খেলনা, সব কবে পাঠাবে?
কাল প্রীতম দিয়ে আসবে।
এখান থেকেই স্কুলে যাব তো?
যেয়ো।
আর দিদি আমার কাছেই থাকবে তো বাবা? দিদি গল্প না বললে আমার খাওয়া হয় না। মণিমা বলেছে, চাঁপা থাকুক।
থাকুক।
তুমি রাগ করোনি তো বাবা?
রাগ? না রাগ করব কেন?
আমি যে মণিমার কাছে চলে এলাম।
তা বলে রাগ করব কেন?
তুমি যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারো না।
দেবাশিস একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, পারি বাবা। পারতে তো হবেই।
নিন্কু বলছিল–তোর বাবা তোকে ছাড়া একা একা ভয় পাবে দেখিস। আমাদের বাড়িতে কি ভূত আছে বাবা?
ভূত? কে তোমাকে ভূতের কথা শেখাচ্ছে? ভূত-টুত আবার কী?
থাপি বলছিল।
কী বলছিল?
রবি বোধ হয় একটু লজ্জা পায়। একটু থেমে বলে, বাবা মানুষ মরে গেলে তো ভূত হয়। তাই—
তাই কী?
থাপি বলেছে। আমি না।
কী বলেছে?
বলেছে মা মরে গিয়ে নাকি ভূত হয়ে আছে ও বাড়িতে।
ও সব বাজে কথা রবি। ও সব বিশ্বাস করতে নেই।
বুড়োদাও বলেছে— ও বাড়িতে আর যাসনে রবি। গেলে তোর মা ঠিক তোর ঘাড় মটকে দেবে। ভূতেরা নাকি যাদের ভালবাসে তাদের মেরে নিজের কাছে নিয়ে যায়।
ছিঃ রবি। এ সব কথা শিখলে তোমাকে আমি ওখান থেকে নিয়ে আসব।
দিদিও আমাকে কত ভূতের গল্প বলে।
আমি চাঁপাকে বারণ করে দেব। ও সব গল্প শুনো না!
আচ্ছা। কিন্তু বাবা—
বলল। দেবাশিসের গলাটা গম্ভীর।
আমি যখন আফটারনুনে ফোন করেছিলাম তখন—
তখন কী?
আমার মনে হয়েছিল আমাদের বাড়িতে মা ফোন ধরেছে।
কী যা তা বলছ?
না না, ওটা রং নাম্বার ছিল। কিন্তু যে লেডি ফোনটা ধরেছিলেন তার গলা শুনে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল মার ভূত ঠিক ফোন ধরেছে?
এ রকম ভাবতে নেই। আর ভেবো না।
বাবা, কাল আমি ইস্কুলে যাব না।
কেন?
আমি তো স্কুল ড্রেস আনিনি, বই খাতাও নয়।
দেবাশিস একটু ভেবে বলল, ঠিক আছে। পরশু থেকে যেয়ো। স্কুলে চিঠি লিখে দেব, বাস এবার ওখানে যাবে।
কাল তা হলে ছুটি বাবা?
ছুটি।
তা হলে কোথায় বেড়াতে যাবে বলো তো!
কোথায়?
রবি ফোনে হাসল। কী মিন্ধ কৌতুকের হাসি। বলে, মণিমা বলেছে কাল আমরা তোমার ফ্ল্যাটে বেড়াতে যাব।
দেবাশিস উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, এখানে। এখানে কাল এসে কী করবে? আমি তো থাকব না।
মণিমা বলছে কাল নিজে আমাকে নিয়ে যাবে, আমার সব জিনিস গুছিয়ে আনবে, আর আমাদের ফ্ল্যাটটা সাজিয়ে দিয়ে আসবে।
না, না তার দরকার নেই।
যাব না?
দরকার কী রবি? আমিই পাঠিয়ে দেব।
দাঁড়াও তা হলে, মণিমাকে বলি।
ফোনের মাউথপিসে হাতচাপা দিয়ে রবি ফুলির সঙ্গে পরামর্শ করছে দৃশ্যটা স্পষ্টই দেখতে পায় দেবাশিস। খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করে। আর সেটুকু সময়ের মধ্যেই সে ভেবে দেখল তার মহিলা ভাগ্য ভাল নয়। প্রথমবার বিয়ে করেছিল চন্দনাকে। পেটে বাচ্চা সমেত। দ্বিতীয়বার যাকে আনছে তারও বড় বড় ছেলেমেয়ে, স্বামী, সংসার সব থেকে ছিঁড়ে আনতে হবে। কোনওবারই তার সহজ সরল বিয়ে হল না। যেন চুপি চুপি পাপ কাজ সারছে।
রবি বলল, হ্যালো?
বলো।
আমরা কাল যাব না।
আচ্ছা।
রবিবারে যাব।
দেবাশিস হেসে বলে, রবিবারে আমিই যাব।
তা হলে?
তা হলে কি রবি?
আমি আমাদের ফ্ল্যাটে বেড়াতে যাব কবে?
আসবে। বেড়াতে আসবে কেন, এ তো তোমার নিজেরই ফ্ল্যাট। যখন খুশি আসতে পারবে। তবে এ সপ্তাহে নয়।
কাল তা হলে আমরা ট্যাক্সিতে কবে দক্ষিণেশ্বরে যাব।
যেয়ো।
ছাড়ছি বাবা। গুডনাইট।
নাইট।
ফোন রেখে দিল দেবাশিস! ভ্রূ কোঁচকানো মুখটায় চিন্তার লেখা।
অন্ধকার ঘরে, পাশের ঘর থেকে আলো এসে লম্বা হয়ে পড়েছে। সেই আলো পিছনে নিয়ে ছায়ামূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে তৃণা।
দেবাশিস অস্ফুট একটা যন্ত্রণার শব্দ করল। যন্ত্রণাটা কোথায় তা বুঝতে পারছিল না।
বলল, রেডি তৃণা?
হুঁ। কিন্তু আমার শরীরটা ভাল নেই।
কী হয়েছে?
কী করে বলব! আজ বড্ড টায়ার্ড।
গাড়িতে তো বসেই থাকবে। খোলা হাওয়ায় দেখো, ভাল লাগবে।
তোমার ফ্ল্যাটে খোলা বাতাসের অভাব নেই।
না, না। চলো প্লিজ। এই ফ্ল্যাটটায় আমার একদম ভাল লাগে না।
কেন, বেশ সুন্দর তো?
কী জানি কেন। বেশিক্ষণ ভাল লাগে না।
তৃণা একটু হাসির শব্দ করে বলে, আমারও কি খারাপ লাগবে দেব?
না। তোমার লাগবে না। আমার তো কতগুলো রিফ্লেক্স আছে। সবই তো তুমি জানো। দেয়ার আর বিটার মেমোরিজ, লোনলিনেস…সব মিলিয়ে একটা সাফোকেশনের মতো হয় মাঝে মাঝে। রবিটারও হত।
রবি ফোনে তোমাকে ভূতের কথা কী বলছিল দেব?
ছেলেমানুষ তো। কে যেন ভয় দেখিয়েছে, ওর মা নাকি ভূত হয়ে আছে এখানে।
তৃণা একটু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎ বলল, যখন দুপুরের পরে ফোন করেছিল তখন রবি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি কে? মা?
তুমি কী বললে?
কী বলব! মিথ্যে করে বললাম রং নাম্বার।
ঠিকই করেছ।
ও কি ভেবেছিল ওর মায়ের ভূত কথা বলছে?
শব্দ করে হাসল দেবাশিস। বলল, হ্যাঁ। আচ্ছা পাগল আমার ছেলেটা।
শোনো।
কী?
আর-একটু পরে বেরোও। আমি একটু বসি। হঠাৎ মাথাটা কেমন ঝিম করে উঠল।