দেবাশিস একটু ভেবে বলল, থাকগে।
উঠে পোশাক পালটে এল দেবাশিস। চা খেল ফের।
ডাকল—তৃণা।
উঁ।
কীভাবে শুরু করা যায় বলো তো!
কী? কীসের কথা বলছ?
বুঝতে পারছ না?
না তো।
তোমার আর আমার এই জীবনটা।
শুরু আবার করবে কীভাবে?
ধরো, বিয়ে হলে পুরুতের মন্ত্র, ফুলশয্যা-টয্যা দিয়ে একটা শুরু করা যায়। রেজিষ্ট্রি করলে তারও সরকারি মন্ত্র আছে। আমরা কী দিয়ে শুরু করব?
তৃণা লজ্জা পেয়ে বলে, ও সব বোলো না। কানে লাগে। আমরা কিছু শুরু করলাম, নাকি শেষ করে এলাম?
তোমার কি তাই মনে হয়? তার উত্তরে বলা যায় যে একটা শেষ না করলে অন্যটা শুরু করা যায় তৃণা।
ফের তত্ত্বকথা।
তুমি যে শুরুটাকে শেষ বলছ!
শোনো দেব, আমি কিছু শেষ করে আসিনি। শুরুর কথাও ভাবিনি। আমি বাড়িতে ভূতের তাড়া খেয়ে বেরিয়ে এসেছি। আমি কী করছি আমি নিজেও জানি না। মাথার ভিতরটায় বড় গণ্ডগোল। আজ আমি কিছু ভাবতে পারছি না। শুধু একটা জিনিস জানি।
কী তৃণা? আগ্রহে দেবাশিস ঝুঁকে বসে।
তোমাকে আমার ভীষণ দরকার এ সময়ে। আর কিছু না।
তৃণা, তবে আমরা সেই আদিমভাবে শুরু করব। যখন কোনও অনুষ্ঠান ছিল না, কেবল শরীর ছিল।
ছিঃ। ওভাবে বোলো না।
দেবাশিস হেলান দিয়ে বসে বলে, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম বদমাশ। মেয়েদের হাতে চিঠি খুঁজে দিতাম। বসন্তবাবুর বাড়ির ছাদে প্রত্যেকদিন ঘুড়ি গোঁত্তা মেরে নামিয়ে দিতাম তাতে লেখা থাকত আই লাভ ইউ। বসন্তবাবুর মেয়ে রানিকে উদ্দেশ করে। তখন শুরু করার কোনও প্রবলেম ছিল না। ভাবতে শিখিনি, রচনা করতে শিখিনি, সাজাতে শিখিনি, ওই ভাবেই শুরু করতাম। চন্দনার সঙ্গেও হুট করে শুরু। প্রথমে শরীর, তারপর ভালবাসার চেষ্টা, যেন ফ্রাস্টেশন অ্যান্ড দি এভ, তোমাকে নিয়ে তো সেভাবে শুরু করা যায় না। আজ আমার মস্ত প্রবলেম।
আজকের দিনটা অত ভেবো না। মাথা ঠাণ্ডা করো।
দেবাশিস শ্বাস ছেড়ে বলে, আজকের দিনটা অদ্ভুত। বুঝলে? আজ রবিকে পার্মানেন্টলি ওর পিসির বাড়িতে দিয়ে এলাম। আর তারপরই শুনলাম তুমি চলে আসছ।
শচীন কিছু বলল না?
কী বলবে?
অধিকার ছেড়ে দিল এক কথায়? তুমিই বা কী বলে এলে?
তৃণা ভ্রূ কুঁচকে বলে, কী বলব? আমি কিছু বলে আসিনি।
দেবাশিস চমকে উঠে বলে, বলে আসোনি?
না। আমি প্রায়ই যেমন বেরোই তেমনি বেরিয়ে এসেছি।
আমার কাছে এসেছ সে কথা কেউ জানে না?
না।
কাউকে বলোনি?
বোকা।
কেন?
তুমি না ফিরলে ওরা তো থানা পুলিশ করবে। হাসপাতালে খোঁজ নেবে।
নেবে! বলছ?
নেবে না?
আমার তো মনে হয় না। ওরা কি জানে যে আমি আছি?
তুমি বোকা তৃণা। বলে আসলেই হয়। শচীনবাবু কি তোমাকে কামড়াত?
তা নয়। ওরা আমাকে নিয়ে বহুকাল ভাবে না। আজ একটু ভাবুক।
দেবাশিস মাথা নেড়ে বলে, তা হয় না।
বলেই উঠে গেল দেবাশিস। ডায়াল করতে লাগল। তৃণা ওর কাছে গিয়ে বলল, ফোন কোরো না। কিছুক্ষণের জন্য আমাকে নিরুদ্দেশ থাকতে দাও। ওরা ভাবুক।
তা হয় না। মাথা নাড়ল দেবাশিস। ফোন কানে তুলে শুনে বলল, এনগেজড।
তৃণা একটা নিশ্চিন্তের খাস ফেলল।
দেবাশিস ঘুরে বলল, আমি যা করব তা পাকাঁপাকি। কোনও অনিশ্চয়তা থাকবে না, দ্বিধা থাকবে।
০৭. পৌনে সাতটা বাজেনি এখনও
॥ সাত ॥
পৌনে সাতটা বাজেনি এখনও। বাজছে প্রায়। সাততলার ঘরের শার্সি দিয়ে দেখা যায়, কলকাতার ওপরকার আকাশটা মস্ত বড়। আকাশে তারা ফুটছে। শহরটা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, আলোয় আলোয় তিলোত্তমা।
বসবার ঘরটা অন্ধকার। কিংবা ঠিক অন্ধকার নয়। একটা রঙিন কাচের ঢাকনার ভিতরে শূন্য শক্তির আলো জ্বলছে। জানলার পর্দা সরানো। বাইরে চাঁদ। ঘরের ভিতরে জ্যোৎস্নার চৌকো চাঁপা রঙের আলো পড়ে আছে। আর ঝড়ের মতো বাতাস।
দেবাশিস একা ভূতের মতো বসে আছে। তার পরনে বাইরে যাওয়ার পোশাক। সামনে দুটো ঠ্যাং ছড়ানো, সোফার কাঁধে হেলানো মাথা। ছাদের দিকে মুখ। দুটো হাত অসহায়ভাবে দুদিকে পড়ে আছে। সে তৃণার কথা ভাবছে। জলস্রোত উলটোপালটা, পালে পাগলা বাতাস, তবু বিপরীতগামী দুটি নৌকো একটা অন্যটার সঙ্গে জুড়ে গেল। বাঃ। বেশ।
তৃণা ও ঘরে সাজছে। তারা বেড়াতে যাবে। তৃণা যেতে চায়নি। শরীরটা আজ ভাল নেই। দেবাশিস বলেছে, বেড়ালে মনটা একটু হালকা হয়। তোমার তো শেকড়ের প্রবলেম আছে।
তৃণা বেড়াতে ভালবাসে না। তার প্রিয় অভ্যাস ঘরের কোণে একা থাকা। ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে,বই পড়বে, গান শুনবে। কেউ কথাটথা বলতে এলে বিরক্ত হয়। রোগে ভুগে ভুগে ছেলেবেলা থেকে ওর ওই অভ্যাস হয়ে গেছে।
ফোনটা বাজছে। দেবাশিস হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিল।
হেল্লো।
মহিলাকণ্ঠে কে বলল, দেবাশিস দাশগুপ্ত আছেন?
বলছি।
ওঃ। দাদা…
ফুলি। ফুলির গলা টেলিফোনে কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। ভীষণ ভয় খেয়ে গেল দেবাশিস। শরীরটা ঝিম ঝিম করে উঠল বিদ্যুৎ স্পর্শে। রবির কোনও কিছু হয়নি তো!
ফুলি! কী হয়েছে?
তুমি ফিরেছ! বাঁচা গেল। রবি সেই থেকে বাবাবাবা করছে। দু’বার ফোন করেছিল।
কী হয়েছে?
কিছু না। কী হবে? অত ভেবো না তো। রবি আছে আমার কাছে আর আমি অনেক ছেলেপুলের মা।
দেবাশিস বিরক্ত হয়ে বলে, কী ব্যাপার বলবি তো!
রবি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। বলছে বাবা কেন দেরি করছে ফিরতে।
মন খারাপ নাকি!
না না। দস্যিপনা করছে সব সময়ে। বেশ আছে।