শোওয়ার ঘর দুটো। একটা খাওয়ার ঘর। একটা বসবার। অনেকটা জায়গা নিয়ে খোলামেলা ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় শোওয়ার ঘরটা রবির। সেখানে অনেক খেলনা, ট্রাইসাইকেল, ছবির বই, ছোট্ট ওয়ার্ডরোব। এই ঘরটায় একটু বেশিক্ষণ থাকল তৃণা। চাকরটাকে বলল, এককাপ কফি করে আনন।
ফোনটা বাজছে বসবার ঘরে। বাজছেই। চাকরটা রান্নাঘরে। ওখান থেকে শুনতে পাবে না। তৃণা ইতস্তত করছিল, ফোন কি সে ধরবে? পরমুহূর্তেই ভাবল অমূলক ভয়। এ বাড়িতে যদি তাকে থাকতেই হয় তবে এ সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলাই উচিত। সে উঠে এল বসবার ঘরে। ফোন হাতে নিয়ে অলস গলায় বলে, হ্যালো।
একটা কচি গলা শোনা গেল বাপি?…ওঃ…থেমে গেল স্বরটা। তারপর নম্বরটা বলে জিজ্ঞেস করল— এটা কি ওই নম্বর?
তৃণা বুঝে নিল, রবি। ফোনের গায়ে লেখা নম্বরটা তৃণারও তো মুখস্থ। বলল, কে বলছ?
তুমি কে? বলে কচি গলাটা অপেক্ষা করল। হঠাৎ ভয়ার্ত গলায় বলল, মা?
তৃণা এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। ফোনটা কানে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। রবি ফোন করছে। যদি তৃণা রং নাম্বার বলে ফোন ছেড়ে দেয় তো রবি আবার ফোন করবে, শুধু আজ নয়, কালও করবে। হয়তো প্রায়ই বাবার সঙ্গে দরকার পড়বে তার, তৃণা কোথায় পালাবে? পালাবেই বা কেন? তবু প্রথম ধাক্কাটা সামলানোর জন্য একটু সময় দরকার। সে চোখ বুজে বলল, রং নাম্বার।
ফোন রেখে দিল। ভেবে পেল না, রবি কেন মা কিনা জিজ্ঞেস করল।
প্রীতম কফি করে এনেছে। সেই সময়েই ফোনটা আবার বাজে। প্রীতম তার দিকে তাকায়। তৃণা ঘাড় হেলিয়ে বলে, রবি ফোন করছে। ওকে আমার কথা বোলো না।
প্রীতম ফোন তুলে নিয়ে বলে, হ্যালো। রবিবাবু?
– না তো। ফোন বাজেনি।
–…
–সাহেব বাইরে গেছেন।
–…
– না আমি একা। তুমি আর আসবে না?
–…
চাঁপাদি আসবে না? আচ্ছা বলে দেব। তোমার সব জিনিস কাল পাঠিয়ে দেব।
–আচ্ছা তুমি আসবে না কেন?
–…
–এলে বলব। ছাড়ছি।
ফোন রেখে প্রীতম একবার আড়চোখে তৃণার দিকে চেয়ে বাইরে চলে গেল।
সাড়ে পাঁচটা। দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।
তৃণা ভেবেছিল দেবাশিস এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুলেই অপ্রস্তুত। দেবাশিস নয়। টেরিলিন পরা দিব্যি ঝকমকে একজন যুবা পুরুষ। সেও একটু অপ্রস্তুত। বলল, দেবাশিস নেই?
না। বেরিয়েছে।
ও। বলে খুব কৌতুহলভরে চেয়ে দেখল তৃণাকে।
তৃণা কি ওকে বসতে বলবে?
লোকটা নিজেই বলে, রবি নেই?
না।
লোকটার চোখে স্পষ্টই একটা প্রশ্ন–আপনি কে? কিন্তু লোকটা সে প্রশ্ন করে না, ভদ্রতায় বাধে। তাই বলল, আমি রবির মামা।
ও? আসুন।
বসে আর কী হবে! কেউ নেই যখন! বলতে বলতেও যুবকটি কিন্তু ঘরে আসে। একটু ইতস্তত করে বসে। একটা শ্বাস ফেলে হাতে হাত ঘসে বলে, আপনি ওর রিলেটিভ বোধ হয়।
তৃণা মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ।
চন্দনা আমার দিদি ছিল।
তৃণা তার এলো চুলের জট আঙুলে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, বুঝেছি, বুঝেছি। বসুন, ও এসে পড়বে। যুবকটি ঘড়ি দেখে বলে, একটু বসতে পারি। আমি ভাবলাম–বলে একটু কথা সাজিয়ে নিয়ে বলে, আসলে কাল আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। বলছিলাম কী দেবাশিসদা তো যাবেনই, সেইসঙ্গে আপনিও… যদিও ঠিক আচমকা এভাবে–
তৃণার ছেলেটির জন্য মায়া হয়। বুঝতে পারছে না, বুঝতে চাইছে। বলল, কফি খান। ও এসে পড়বে।
ছেলেটি প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে তাকে দেখতে থাকে! চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নেয়। কিন্তু দেখে। তৃণা কফি বানাতে বলবার ছল করে উঠে এল। রান্নাঘরে প্রীতমকে খবর দিয়ে শোওয়ার ঘরে গিয়ে বসে রইল চুপচাপ। শুনল, ওঘরে প্রীতমের সঙ্গে কথা বলছে লোকটা। চাপা স্বর। এরকমই হবে এর পর থেকে। তৃণার জায়গাটা স্থির হতে অনেক সময় লাণবে। অনেক সময়। তৃণা শুষ্কমুখে বসে থাকে। চুলের জট ছাড়ায় অনামনে।
দেবাশিসের ফিরতে ছ’টা বেজে গেল। তখনও ছেলেটা বসে আছে সামনের ঘরে। আর দেবাশিসের হাতে কয়েকটা শাড়ির প্যাকেট, রজনীগন্ধার ডাঁটি, কসমেটিক্সের বাক্স, খাবারের বাক্স। চন্দনার ভাই সে সব দেখে অবাক। পর্দার ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটা দেখল তৃণা।
না, দেবাশিস খুব একটা ঘাবড়াল না। চালাক লোকরা এরকম বিপদে পড়লে খুব গম্ভীর হয়ে যায়। দেবাশিসও হল। দু-চারটি কী কথা হল ওদের। ছেলেটা চলে গেল।
দেবাশিস বেশ হাঁক ছেড়ে ডাকল— তৃণা।
তৃণা ঘরের মাঝখানটায় গিয়ে পরদা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, কী?
দেবাশিস একগাল হাসি হেসে বলল, সব এনেছি।
কোত্থেকে?
তোমাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে হঠাৎ মনে পড়ল যাদবপুরে যখন থাকতাম তখন দেখেছি ওই অঞ্চলে রবিবারে দোকান খোলা থাকে। গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম, দেখো তো সব!
সব দেখে তৃণা হেসে কুটিপাটি। বলল, কী এনেছ এ সব?
কেন?
এ রংচঙে শাড়ি আমি পরি নাকি?
পরো না?
এসব তো রেবা পরে। আর অত কসমেটিক্স! হায় রে আমি কবে আবার ও সব আলট্রা মডার্ন লিপস্টিক মাখি, কিংবা কাজল!
দেবাশিস হেসে বলে, এবার মেখে। বুড়ি সাজা তোমার কবে ঘুচবে বলো তো!
মেয়ে বড় হয়েছে দেব, কদিন পরেই প্রেম করবে। এখনই করছে কি না কে জানে!
দেবাশিস হেসে বলে, বাঙালি মেয়েদের ওই হচ্ছে রোগ। তুমি সাজবে না কেন তৃণা?
তৃণা শুধু হাসল। স্নিগ্ধ হাসি। বলল, রবি ফোন করেছিল।
দেবাশিসের মুখের হাসিটা মরে গেল, বলল, কী বলল?
আমি ধরেছিলাম। রং নাম্বার বলে ছেড়ে দিয়েছি। পরে আবার ফোন করেছিল, তখন প্রীতম ধরে।