তৃণা তাকিয়ে রইল।
দেবাশিস বলল, আর আমাকে এখন ও সব ভয়ের কথা বোলো না। তোমারও যদি ভেঁড়া শেকড় অন্য জায়গায় থেকে থাকে তবে আমার কী হবে? আজ থেকে রবিও পর হয়ে গেল।
তৃণা স্নিগ্ধস্বরে বলল, রবির জন্য তোমার বুকের ভিতরটা কেমন করে দেব, তা বোঝো না!
ভীষণ বুঝি।
ওটুকু কি আমার হতে নেই?
দেবাশিস চুপ করে গেল। জোব্বা জামার পকেট থেকে ফের সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনল। ধরাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।
তৃণা তেমনি স্নিগ্ধস্বরে বলল, আমরা তো আর ঠিক সকলের মতো হতে পারি না।
দেবাশিস বলল, তাও ঠিক। তবে আমরা কী রকম হব তৃণা।
খুব সুখী হব না, একটু কী যেন থেকে যাবে দুজনের মধ্যে!
তুমি কী ভীষণ স্পষ্ট কথা বলছ আজ তৃণা!
আজই বলে নেওয়া ভাল।
কেন? আজই কেন?
তৃণা চোখ মুছে হাসিমুখে বলে, আজ সপ্তাহের ছুটির দিন। তোমার সময় আছে। কাল থেকে তো তুমি আবার ব্যস্ত মানুষ। তোমার কি আর সময় হবে?
তুমি কথাটা ঘোরালে তৃণা। তু
মি বাথরুমে যাও। আমার খিদে পেয়েছে।
দেবাশিস তবু বসে রইল। চুপচাপ। অনেকক্ষণ বাদে মুখ তুলে বলে, তৃণা।
বলো।
মানুষকে তার সব সম্পর্ক থেকে ছিঁড়ে আনা যায় না। একজনকে ভাল না বাসলেই যে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল এমন নয়। আবার কাউকে ভালবাসলেই যে নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠল এও নয়। তবে ভালবাসা দিয়ে আমার কী করব?
তৃণা কপালটা টিপে ধরে বলল, ও, আবার সেই তত্ত্বকথা! জানো না মেয়েরা তত্বকথা ভালবাসে না! মাথা ধরেছে, তুমি তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এসো।
টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে প্রীতম। বড় রেস্টুরেন্টের দামি সব খাবার। প্রীতমের মুখে খুব একটা হাসি নেই। কেবল বিনয় আছে।
দেবাশিস যখন খাওয়ার টেবিলের ধারে এসে বসল তখনও তৃণা নিজের কপাল টিপে আছে, বলল, তোমার চাকরকে পাঠিয়ে একটু মাথা ধরার বড়ি আনিয়ে দাও।
দেবাশিস মৃদুস্বরে বলে, ও তোমার চাকর। অবশ্য পাঠানোর দরকার নেই। মাথাধরার বড়িটড়ি আছে বোধ হয়। খুঁজতে হবে।
খিদে চেপে রাখলে, বা কাঁদলে আমার মাথা ধরে।
দেবাশিস চোখ তুলে ইঙ্গিতে প্রীতমকে সরিয়ে দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে তৃণার একখানা হাত ধরে বলল, তুমি প্রস্তুত হয়ে আসোনি জানি। হুট করে চলে এসেছ। তাই কাঁদছ। কিন্তু আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম তোমার জন্য।
তৃণা হেসে বলল, খুব প্রস্তুত! একখানা শাড়িও যদি কিনে রাখতে। কাল আমাকে বাসি কাপড়ে সকালবেলাটা কাটাতে হবে, যতক্ষণ শাড়ি কেনা না হয়।
একটা দিন সময় দাও! প্লিজ। কাল থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ দোকান বন্ধ।
তৃণা মাথা নেড়ে বলল, সময়! সময়। দাঁড়াও, সময় নিয়ে কী একটা কবিতার লাইন মনে আসছে—
এল না। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়!
দেবাশিস বলে, খেয়ে একটু রেস্ট নাও। শোওয়ার ঘরের পরদাগুলো টেনে দিচ্ছি, ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকো একটু।
তুমি কোথায় যাবে?
কোথাও না। তোমার কাছেই বসে থাকব। বক বক করব।
তৃণা সস্নেহে হাসল।
পাঁচটা প্রায় বাজে। সাততলা ফ্ল্যাটের শার্শির গায়ে অত্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি রোদ এসে পড়েছে। এখনও অনেক বেলা আছে। অন্ধকার হতে এখনও অনেক বাকি। পরদায় ঢাকা শোওয়ার ঘরে শুয়ে আছে তৃণা। গায়ে খয়েরি পরদার আলোর আভা। দুটো বড়ি খাওয়ার পর আস্তে আস্তে মাথাধরাটা সেরে যাচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। তবু কি ঘুম আসে! দেবাশিস অনেকক্ষণ মাথাটা টিপে দিল। ঝিম মেরে শুয়ে ছিল তৃণা, ঘুমের ভান করে। সে ঘুমিয়েছে মনে করে দেবাশিস উঠে গেছে পা টিপে টিপে।
ঘরটা ঠিক অন্ধকার হয়নি। আবার আলোও নেই। সাততলার ওপর খুবই নিরাপদ আশ্রয়। একা শুয়ে আছে তৃণা। মাথা ধরা সেরে গেছে। নরম বিছানায় এলিয়ে আছে ক্লান্ত শরীর। এ একরকমের আলস্য। সুন্দর আলসেমি। কিন্তু ঘুম হবে না। আরও কতকাল ঘুম হবে না তৃণার।
সে চোখ চেয়ে দেখল ছাদের মসৃণ রং, চৌকো দেয়াল। দেয়ালে রহস্যময় আলো। চেয়ে থাকতেই সেই সুড়সুড়ির মতো একটা অনুভব। কে যেন দেখছে। খুব নিবিষ্টভাবে দেখছে তাকে।
চমকে উঠল তৃণা। মাথাটা একবার তুলে চারদিকে তাকাল। আবার মাথাটা বালিশে রেখে চোখ বোজে! কিন্তু অবিরল তার ওই অনুভূতি হয়, কে যেন দেখছে। ভীষণ দেখছে। চন্দনার ভূত? নাকি তার মনেরই প্রক্ষেপ? সে নিজেই হয়তো। ভাবতে ভাবতে মুখটা আস্তে ফেরাল তৃণা। চোখটা আপনা থেকেই খুলে গেল। আর ভীষণভাবে চিৎকার করে উঠে বসে সে কে? কে?
খাওয়ার ঘরের দিকটার দরজার পরদার ওপাশে যে দাঁড়িয়ে ছিল সে পরদাটা আস্তে সরিয়ে মুখ বাড়াল ভিতরে। ভার গলায় বলে, আমি, প্রীতম।
তৃণা অবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ে থেকে বলে, কী চাও?
চাকরটা একটু ভয়ের হাসি হেসে বলে, সাহেব বলে গেলেন আপনি ঘুম থেকে উঠলে খবর দিতে, উনি একটু কোথায় বেরোলেন। এক্ষুনি আসবেন।
কোথায় গেছেন?
বলে যাননি। গাড়ি নিয়ে গেলেন দেখেছি।
ও।
তৃণার বুকের ভিতরটা এখনও ঠক ঠক করছে। শ্লথ আঁচল টেনে নিয়ে সে উঠল। বলল, দাঁড়াও। তোমাদের ঘরটরগুলো আমাকে একটু দেখিয়ে দাও। চিনে রাখি।
চাকরটা উত্তর করল না, খুশিও হয়নি। তবু এক রকম বিরক্তি বা ঘেন্না চেপে রাখা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ও হয়তো ভাবছে, সাহেব রাস্তার মেয়েছেলে ধরে এনেছে, রাখবে। দেবাশিস তো ওকে বলেনি যে তৃণা আসলে কে! বললেও বুঝবে না। এমন অবস্থার দুটি মানুষের ভিতরকার প্রেমের সত্য কে কবে বুঝেছে। সবাই একটা কিছু ধরে নেয়।