কিছুতেই কিন্তু ভাবা যাচ্ছে না যে তৃণা চলে এসেছে চিরকালের মতো। হাতের নাগালে বসে আছে। একই ফ্ল্যাটে এরপর থেকে তারা থাকবে। দেবাশিস ভেবেছিল, এ এক অসম্ভব প্রেম। দুটো নৌকো, স্রোত…আরও কী কী যেন।
তৃণা বাথরুমে স্নান করছে। দেবাশিস বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করে। বিকেল চারটে বাজে মোটে। প্রীতম একবার চা দিয়ে গেছে। তারপর দোকানে গেছে খাবার আনতে। তৃণা এলে তারা খাবে।
দেবাশিস সিগারেট ধরিয়ে তার ফ্ল্যাটের বিশাল জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়। বহু নীচে ফুটপাথ। এই সেই খুনি জানলা। অত নীচে কী করে, কোন সাহসে লাফিয়ে পড়েছিল চন্দনা? হাত পা হঠাৎ নিশপিশিয়ে ওঠে তার।
ভাল করে পর্দা সরিয়ে পাল্লা খুলে ঝুঁকে দেখল দেবাশিস। ঝিম ঝিম করে ওঠে মাথা। অবলম্বনহীন শূন্যতা তাকে দু হাত বাড়িয়ে আকর্ষণ করে, এসো এসো। সাততলার ওপর সারাদিন, সব ঋতুতেই প্রচণ্ড হাওয়া খেলা করে, কী বাতাস? মার মার করে ছুটে আসছে ঠাণ্ডা, বুক জুড়োনো বাতাস। তবু অত হাওয়াতেও দেবাশিসের মুখে ঘাম ফুটে ওঠে। কত নীচে ফুটপাথ! কী তীব্র আকর্ষণ অধঃপাতের! সবসময়েই, অবিরল পৃথিবী তার বুকের কাছে সবাইকে টানছে। যখন জানলার চৌকাঠের অবলম্বন। জীবনে শেষবারের মতো ছেড়ে দিয়েছিল চন্দনা, ফুটপাথ স্পর্শ করবার আগে এই যে অবলম্বনহীন দীর্ঘ শূন্যতা বেয়ে নেমে গিয়েছিল তার শরীর, এই শূন্যতাটুকু কীভাবে অতিক্রম করেছিল ও? বাঁচতে ইচ্ছে করেনি ফের? কারও কথা মনে পড়েনি? কেঁদেছিল? এই পথটুকু, এই শূন্যতাটুকুতে চন্দনা কি চন্দনা ছিল? খুব জানতে ইচ্ছে করে। দেবাশিস কোমর পর্যন্ত শরীরের ওপরের অংশ ঝুলিয়ে দিল জানলার বাইরে! চেয়ে রইল নীচের দিকে। পোকার মতো মানুষ হাঁটছে, গাড়ি যাচ্ছে, একটা-দুটো গাছ, কালো মিশমিশে রাস্তা। কী ভয়ংকর! মুখের সিগারেটটা বাতাসে পুড়ে গেল দ্রুত। শেষ অংশটা ছুড়ে দিল দেবাশিস। বাতাসে খানিকটা ভেসে গেল, তারপর অনেক অনেকক্ষণ ধরে পড়তে লাগল নীচে…নীচে…নীচে…।
বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ। তৃণা বেরিয়ে এল। দে
বাশিস শরীরটা তুলে আনল ভিতরে। বাতাস লেগে চোখে জল এসে গেছে।
তৃণার কান্না আর বিষণ্ণতা স্নানের পর ধুয়ে গেছে। কিছুটা গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। শোওয়ার ঘরে দুটো একা খাট, বিছানা পাতা। তার পাশে একটা পর্দা-ঘেরা সাজবার ঘর। জানলার পাশেই লম্বা আয়না-লাগানো সাজবার টেবিল। তৃণা সেখানে গিয়ে বসল। চন্দনা এখানে বসে সাজত।
তৃণা নিজেকে আয়নায় দেখল। কিছু তেমন দেখবার নেই। একটু সামান্য সাজগোজ করল। চুলটা ফেরাল। কোনওদিনই সে খুব একটা সাজে না।
আয়নায় দেবাশিসের ছায়া পড়ল। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে একটু হাসি। চুলগুলো খুব এলোমেলো।
বলল, কেমন লাগছে তৃণা?
তৃণা বিষণ্ণ হেসে বলল, ভালই।
আজ থেকে…বলে চুপ করে দেবাশিস। কী বলবে?
তৃণা কথাটা পূরণ করে নিল মনে মনে। লজ্জায় মাথা নোয়াল। বলল, তুমি যাও দেব। স্নান করে এসো।
দেবাশিস আঙুলে ধরা সিগারেটটা তুলে দেখাল, বলল, যাচ্ছি। সিগারেটটা শেষ করে নিই।
অন্তত ও ঘরে যাও। পুরুষের সামনে আমি সাজতে পারি না।
ও। বলে দেবাশিস পর্দার ওপারে গেল। ওখান থেকেই বলল, শোনো তৃণা, তোমার যা যা দরকার প্রীতমকে দিয়ে আনিয়ে নাও। আজ রোববার, দোকান অবশ্য সবই বন্ধ।
কী আনাব? আমার কিছু দরকার নেই।
এক কাপড়ে তো বেরিয়ে এসেছ।
চন্দনার শাড়ি টাড়ি কিছু নেই?
না। সব বিলিয়ে দিয়েছি।
কেন দিলে?
রবির জন্য। ও সব থাকলেই তো ওর মায়ের কথা মনে পড়ত।
তৃণা বেশ ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ একথায় বুকে একটা ধাক্কা খেল। তবু হেসে বলে, তবু কি মনে পড়ে না?
পড়ে। সেটা চেপে রাখে। আমার ফ্ল্যাটটা কিন্তু আমি সাজাইনি, চন্দনা সাজিয়েছিল। সেইভাবেই সব আছে। এক একবার ভাবতাম সাজানোর প্যাটার্ন পাল্টে দিই। কিন্তু সময় পাইনি, এত কাজ। সেই সাজানো ঘরে চন্দনার কথা ওর মনে তো পড়বেই। এবার তুমি সাজাও।
দূর বোকা। মনে পড়া কি ওভাবে হয়! তুমি জানো না।
দেবাশিস একটা শ্বাস ফেলে বলল, আর রবির জন্য আমার ভাবনা নেই। ফুলির বাড়ির দঙ্গলে মিশে গেলে আর কিছু ওর মনে থাকবে না।
সিগারেটটা শেষ হয়েছে?
হয়েছে।
এবার যাও। আমার এখন খুব খিদে পাচ্ছে।
তোমার কী কী দরকার বললে না?
অনেক কিছুই দরকার। কিছু তো আনিনি। সে পরে হলেও চলবে।
লজ্জা কোরো না। এ তো আর পরের বাড়ি নয়। তোমার নিজের।
তৃণা একটু শ্বাস ফেলে বলল, তাই বুঝি?
নয়?
তৃণা একটু হেসে বলে, এত সহজে কি নিজের হয়? অনেক সময় লাগবে। আমাকে একটু সময় দিয়ো, তাড়া দিয়ো না।
দেবাশিস একটু উষ্মভরে পরদার ওপাশ থেকে বলে, কেন? সময় লাগবে কেন?
লাগবে না! গাছ উপড়ে দেখো তার শিকড়ের সবটা কি একবারে উঠে আসে? কত শিকড় বাকড়ের হেঁড়া সুতো কিছু কিছু মাটির মধ্যে থেকে যায়।
তৃণা—
উঁ।
গাছ তো একটানে ওপড়ানো হয়নি। দীর্ঘকাল ধরে তার শিকড়ের মাটি ক্ষয় হয়ে ছিল না কি!
আবার বলছি, তুমি বোকা।
কেন?
উপমা দিয়ে কি সব বোঝানো যায়? গাছের সঙ্গে মানুষের কিছু তফাত আছেই।
পরদা সরিয়ে উত্তেজিত দেবাশিস ও ঘরে চলে এল হঠাৎ। মেঝেতে তৃণার কাছে বসে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে বলল, তৃণা, আমি বড় কাঙাল।
জানি তো।
আজ আমার কেউ নেই।