দেবাশিস অবিশ্বাসভরে চেয়ে থাকে। রবি রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাবার দিকে চেয়ে হাসে। তারপর হঠাৎ প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভার বের করে আনে। বাপের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে থাকে-ঠিসং…ঠিং…
দেবাশিস একবার ভাবল ফিরে যাবেফুলির বাসায়। তারপর ভাবল–থাক। ওরও তো ছেলেমেয়ে আছে। কেউ তো পড়ে মরেনি কখনও!
রবির দিকে চেয়ে দেবাশিস একটু হাসে। তার বুকে কোথায় যেন রবির খেলনা রিভলভারের মিথ্যে গুলি এসে লাগে। সে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে কোনওক্রমে হুইলের পিছনে বসে পড়ে। তারপর গভীরভাবে কয়েকটা শ্বাস নেয়।
গাড়ি ছাড়ে। কিন্তু উইন্ডস্ক্রিন জুড়ে কেবলই দোতলার রেলিং থেকে ঝুঁকে-থাকা রবির চেহারাটাকে দেখতে পায়। চমকে চমকে ওঠে। দাঁতে দাঁত চাপে। হুইলে তার মুঠো করা হাত প্রবল চাপে সাদা হয়ে যায়। পদে পদে ভুলভাবে গাড়ি চালাতে থাকে সে।…
রবির মা চন্দনা লাফিয়ে পড়েছিল সাততলা থেকে, কথাটা ভুলতে পারে না।
রবিও কি কিছু ভোলেনি? সব মনে রেখেছে।
তৃণার সঙ্গে দেখা হবে। ফাঁড়ির কাছের বাসস্টপে। দেবাশিস খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে থাকে।
০৬. দুপুরের ফাঁকা রাস্তায়
॥ ছয় ॥
দুপুরের ফাঁকা রাস্তায় তৃণা একটু বেশি তাড়াতাড়ি হাঁটছিল। পিছনে কে যেন আসছে! ফিরে দেখল। কেউ না। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে, পিছনে কে আসছে। কে যেন চুপিচুপি আসছে। কার চোখ তীব্রভাবে, গোয়েন্দার মতো নজর করছে তাকে। কেউ নয়। তবু তৃণা প্রাণপণে হাঁটে। বড় রাস্তায় তুখোড় রোদ। দোকান বাজার বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা, তৃণা কি আজ খুন হবে? গোপন থেকে কোন আততায়ি কেবলই আসে তৃণার দিকে?
তৃণা চারধারে তাকায়। কেউ নয়। উল্টোবাগে চলে এসেছে অনেকখানি। বাসস্টপটা এখনও বেশ দূরে। তৃণা বেশি হাঁটতে পারে না। হাঁটা জিনিসটা বড্ড ক্লান্তিকর। রিকশাতেও সে কখনও ওঠে না। বড় মায়া হয়। দুপুরের পিচ-গলা রাস্তায়, এই চাবুক রোদে রোগা মানুষগুলো রিকশা টানে, তাতে সওয়ার হতে একদম ভাল লাগে না তার।
ল্যান্সডাউনের মোড়ে পেট্রলপাম্পের কাছ ঘেঁষে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সিওলা হাঁটু তুলে বসে ছোট্ট একটা বই পড়ছে। সম্ভবত রেসের বই, কিংবা গীতাও হতে পারে। একা ট্যাক্সিতে তৃণা ওঠে না। ভয় করে। কিন্তু শরীরটা কেমন যেন কাঁপছে। ভয় করছে। উৎকণ্ঠা।
সাহস করে দু’পা এগোল তৃণা।
ভাই, ট্যাক্সি কি যাবে?
যাবে। ট্যাক্সিওলা গভীরভাবে বলে।
ট্যাক্সিটা দক্ষিণদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। তৃণা উঠতেই ট্যাক্সিটা ওই দিকেই চলতে থাকে, তৃণা কিছু বলেনি। তখন সে সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল রেবার ঘরে সে বসে আছে, আর রেবা হৃদয়হীনা রেবা তার দিকে স্বচ্ছ শীতল চোখে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই সে তার ছেলেকে দেখতে পায়। মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান মনু তাকে কোলে করে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। কী সুন্দর মনুর গায়ের গন্ধটুকু। আবার দেখে শচীন পিং পং টেবিলের ওপাশে বসে আছে, বলছে–তোমাকে আজকাল আমি লক্ষ করি না…
ভ্রূ কোঁচকায় তৃণা। তার সংসারে সে আজকাল আর নেই। কেউ তাকে লক্ষ করে না। এ কেমন? সে ও বাড়ির কারও মা, কারও গৃহকত্রী। তার অতবড় পতন, ওই কলঙ্ক, পরকীয়া ভালবাসা, এ সব ওদের একেবারেই কেন উত্তেজিত ও দুঃখিত করে না? কেন ওদের শান্তি ও স্বাভাবিকতা অক্ষুন্ন আছে? এ কি শচীনের ষড়যন্ত্র! শচীন কি ওদের শিখিয়ে রেখেছে ওর দিকে তাকিয়ো না, কথা বোলো না, ওকে উপেক্ষা করো। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই।
ট্যাক্সিওলা আয়না দিয়ে তাকে দেখছিল। ঘোট আয়না, তাতে শুধু মধ্যবয়স্ক ও জোয়ান চেহারার ট্যাক্সিওলার ক্রুর চোখদুটো দেখা যায়। ফট করে চোখ পড়তেই চমকে উঠল তৃণা। আতঙ্কিত একটা শব্দ উঠে এসেছিল গলায়। অস্ফুট শব্দটা মুখে হাত চাপা দিয়ে আটকাল। বলল, থামুন।
এইখানে নামবেন? বলে ট্যাক্সিওলা গাড়ি আস্তে করল।
এইখানেই। বলে তৃণা অবাক হয়ে দেখে, সে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে এসেছে, এদিকে তার আসার কথা নয়। সে যাবে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে বাসস্টপে। বার বার সে কেন তবে সে-জায়গা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে অন্যমনস্কতায়, বিভ্রমে? তৃণা আস্তে করে বলল, এটা কোন জায়গা! দেশপ্রিয় পার্ক?
হ্যাঁ, এখানেই নামবেন? বলে মধ্যবয়স্ক জোয়ান লোকটা তার দিকে পরিপূর্ণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। লোকটার মুখে ঘাম, অশিক্ষার ছাপ! বন্যজন্তুর মতো একটা কামস্পৃহা লক্ষ করে তৃণা। বুকটা একটু কেঁপে ওঠে। গাড়ির দরজার হাতলটা কিছুতেই খুলতে পারছিল না তৃণা। খুব তাড়াহুড়ো করছিল। একবার মনে হল, লোকটা কোনও কৌশলে দরজাটা আটকে দেয়নি তো! যাতে তৃণা খুলতে না পারে! লোকটাই হঠাৎ তার প্রকাণ্ড ঘেমো হাতটা বাড়িয়ে তৃণার হাতটা ঠেলে লকটা খুলে দিল।
তৃণা নেমে চলে যাচ্ছিল। খুব তাড়া। লোকটা পিছনে থেকে খুব একটা ব্যঙ্গের গলায় বলল, ভাড়াটা কে দেবে?
তাড়াতাড়িতে আর ভয়ে কত ভুল হয়। তৃণা ব্যাগ খুলে ভাড়া দিয়ে দিল। লজ্জায় কান-মুখ ঝাঁ ঝাঁ করছে।
ট্যাক্সিওলার চোখের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি পালানোর জন্যই তৃণা এলোপাথাড়ি খানিক হাঁটল উদভ্রান্তের মতো, চলে এল রাসবিহারী অ্যাভিনিউ পর্যন্ত। কিছুতেই তার মনে পড়ছিল না এখান থেকে কোন রুটের বাস ফাঁড়ি পর্যন্ত যায়। মনটা বড় অশান্ত, বুকের মধ্যে কেবলই একটা পাখা ঝাপটানোর শব্দ, কাকাতুয়াটা ডাকছে…তৃণা…তৃণা…তৃণা…।