চাঁপা ডাইনিং রুমে এনে চেয়ার টেবিলে বসায় রবিকে। রবি বিরক্ত হয়ে চাঁপাকে আঁকড়ে ধরে বলেউঃ! তুমি আগে বাসো, আমি তোমার কোলে বসব।
চাঁপা চারধারে চেয়ে কানে কানে বলেআমি কি চেয়ারে বসতে পারি? বাবা দেখলে যে রাগ করবে।
একটুও রাগ করবে না। উঃ বোসো! কথা শোনো না কেন?
বসছি বসছি। বলে চাঁপা তাকে কোলে নিয়ে বসে। প্লেটে সেঁকা রুটি মাখন, দুধের গেলাস রেখে যায় প্রীতম চাকর। রেখে সে বলে, রবি, কাল যখন সন্ধেবেলা আমি ঘুমোচ্ছিলাম তখন কে আমার কানে জল ঢেলে পালিয়ে গেল শুনি।
তুই ঘুমোস কেন সন্ধেবেলা? বাবা রাগ করে না?
ও ঘুম নয়। চোখ বুজে তোমার জন্য একটা গল্প ভাবছিলাম আর তুমি জল ঢেলে পালিয়ে গেলে। কানের মধ্যে এখনও জলটা ফচ ফচ করছে। আজ বাবাকে যদি বলে না দিই!
পকেট থেকে গম্ভীর ভাবে রিভলভারটা বের করে রবি তুলেই ট্রিগার টেপে। ঠিসুং…ঠিসুং…ঠিসুং…আঃ আ আ, বলে প্রীতম টাল খেয়ে পড়ে যেতে যেতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে রবি বলে, তারপর বলো।
চাঁপা অসহায় ভাবে বলে, কী যেন বলছিলাম!
বড্ড ভুলে যাও তুমি।
বুড়ো হচ্ছি না!
বুড়ো হলে কি ভুলে যেতে হয়?
চাঁপা তার গালে গালটা ছুঁইয়েই সরিয়ে নেয় মুখ, বলে, বুড়ো পুরুতমশাই বলেন বাপপিতেমোর আত্মারা সব সময়ে আমাদের নাকি চোখে চোখে রাখেন। এমনিতে কিছু করতে পারেন না, কিন্তু প্রাণ ভরে ডাকলে তারা এসে আপদ বিপদের আসান করে দিয়ে যান। শিবুচরণ তখন ডাকতে থাকে ও মোর বাপপিতেমো, তোমরা কে কোথায় আছ, দ্যাখোসে তোমাদের আদরের শিবের দশাখানা। নিশুত রাতে কে বা জানবে শিবেকে দংশেছে নিঘিন্নে জীব, কে ডাকবে ওঝাবদ্যি, শিবে যে যায়…এইসব বিড়বিড় করে বলছে যখন, তখনই সাপটা হঠাৎ ঠিক মানুষের গলায় বলে, ওহে শিবুচরণ—
ও-ঘর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দরজায় দাঁড়ায় দেবাশিস। একটু ভারী গলায় বলে, হারি আপ, হারি আপ–
গী— মুখ ফিরিয়ে হাসে রবি। চাঁপা জড়োসড়ো হয়ে উঠে দাঁড়ায়, কোলে রবি।
দৃশ্যটা দেখে একটু হাসে দেবাশিস, পর্দাটা ফেলে দেয়। ও ঘর থেকে তার গলা পাওয়া যায়ড্রেস আপ ম্যান, ড্রেস আপ।
ইয়া। উত্তর দেয় রবি, তারপর দুটো টেস্ট দু’কামড় করে খেয়ে ফেলে দিয়ে বলে, দিদি, তাড়াতাড়ি করো।
কিছু খেলে না সোনাবাবু!
আঃ খেতে ইচ্ছে করছে না যে।
দুধটুকু তবে দু’ চুমুক, দাদা আমার!
ই কী যে যন্ত্রণা করো না! বলে রবি ঢকঢক করে দুধটা খায়। হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছে ছুটে পাশের ঘরে গিয়ে ডাকে— দিদি, তাড়াতাড়ি।
দেবাশিস ভিতরদিকের দরজা ভেজিয়ে দিল সাবধানে। রবি ও ঘরে পোশাক করছে। ঘড়িতে আটটা বাজে। তৃণা এখন নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে। ও একটু দেরিতে ওঠে। ওদের বাড়ির এখনকার দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে দেখে নিল দেবাশিস। তৃণার বর শচীন এখন বাগানে। এমন ফুল-পাগল, গাছ-উন্মাদ লোক কদাচিৎ দেখা যায়। কেবল মাত্র ওই গাছের জন্য ফুলের জন্য হাজরা রোডের সাতকাঠার মতো জমি সোনার দাম পেয়েও বেচবে না। ওই সাতকাঠার কোনও দরকারই হয় না ওদের, বাড়ির চারধারে বিস্তর জমি। বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা, রাস্তার ও পাশে ওই ফালতু জমিটায় তার বাগান। এতক্ষণে সেখানে গাছপালার মধ্যে জমে গেছে শচীন। তৃণার এক ছেলে, এক মেয়ে, মনু আর রেবা। মনু টেনিস শিখতে যায় রবিবারে, রেবার নাচগানের ক্লাশ থাকে। আটটা থেকে সোয়া আটটার মধ্যে তৃণার চারধারে চাকর-বাকর ছাড়া কেউ বড় একটা থাকে না। অবশ্য থাকলেও ক্ষতি নেই। সবাই জানে, দেবাশিস আর তৃণার মধ্যে একটা প্লাস চিহ্ন আছে। এমন কী দেবাশিসের বউ চন্দনা আত্মহত্যা করেছিল না খুন হয়েছিল এ বিষয়ে সকলের সন্দেহ কাটেনি এখনও। পুলিশ অবশ্য কেস দিয়েছিল কোর্টে খুনের দায়ে দেবাশিসকে জড়িয়ে, তবে দুর্বল কেসটা টেকেনি। কিন্তু জনগণের মধ্যে এখনও সম্ভবত দেবাশিস আসামি।
ডায়াল করার পর নির্ভুল রিং-এর শব্দ হতে থাকে আর দেবাশিসের একটা দুটো হৃৎস্পন্দন হারিয়ে যায়। শ্বাসের কেমন একটা কষ্ট হতে থাকে।
হেল্লো। তৃণা বলে।
দেব।
বুঝেছি।
কথা বলার অসুবিধে নেই তো!
একটু আছে।
ঘরে কেউ আছে নাকি?
হুঁ।
তা হলে দশ মিনিট পরে ফোন করব।
তৃণা একটু হাসে। বলে, না না, ভয় নেই এসময়ে কেউ থাকে নাকি! একে রোববার, তার ওপর বাদলা ছেড়ে কেমন শরতের রোদ উঠেছে। কেবল আমিই পড়ে আছি একা, কেউ নেই।
কী করছিলে?
টেলিফোনটা পাশে নিয়ে বসে ছিলাম, হাতে খোলা জীবনানন্দের সাতটি তারার তিমির; কিন্তু একটা কবিতাও পড়া হচ্ছিল না।
দেবাশিস গলাটা সাফ করে নিয়ে বলে, কী করবে আজ?
কী আর! বসে থাকব। তুমি?
আজকাল রবি ছুটির দিনগুলোয় চাঁপার কাছে থাকতে চায় না।
বড় হচ্ছে তো, রক্তের টান টের পায়। শত হলেও তুমি বাপ।
তুমি বেরোচ্ছ না?
তৃণা একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, জানোই তো, চারদিকে লোকনিন্দের কাঁটাবেড়া, একা বেরোলেই শচীন এমন একরকম কুটিল চোখে তাকায়! আজকাল বুড়ো বয়সে বড্ড সাসপিশাস হয়েছে। ছেলেমেয়েরাও পছন্দ করে না। তাই আটকে থাকি ঘরে।
দুর! ওটা কোনও কথা হল নাকি?
তবে কথাটা কী রকম হলে মশাইয়ের পছন্দ?
আমি বলি, তুমিও বেরিয়ে পড়ো, আমিও বেরিয়ে পড়ি।
তারপর?
কোথাও মিট করব।
তৃণা একটু চুপ করে থেকে বলে, দেব, রবি কিন্তু বড় হচ্ছে।