দেবাশিস একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে বলল, আমি তো ও যা চায় দিই।
আহা! বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে মা আর সঙ্গী। তা ও পায় কোথায়! আমি বলি, আমার কাছ থাক। মণিমা-মণিমা করে কেমন অস্থির হয় দেখনি?
দেবাশিস একটু হেসে বলে, তোরই তো অনেক ক’জন, তার ওপর আবার রবি এসে জুটলে—
ফুলি ধমকে ওঠে–ও সব অলক্ষুণে কথা বোলো না! ছেলেমেয়ে আবার বেশি হয় না কি?
দেবাশিস হাসে, বলে, তোর তা হলে এখনও ছেলেমেয়ের সাধ মেটেনি?
ফুলি কড়া গলায় বলে, না। মিটবেও না। আমি বাপু, ছেলেপুলে কখনও বাড়তি দেখি না। যত হবে তত চাইব। মা হয়েছি কীসের জন্য?
যদিও এটা কোনও যুক্তি নয়, তবু এর প্রতিবাদও হয় না। কারণ এ যুক্তির চেয়ে অনেক জোরালো জিনিস। এ হচ্ছে বিশ্বাস। শিশিরের সঙ্গে থেকেই বোধ হয় এইসব গ্রাম্যতা ওর মনে পাকাপোক্ত হয়ে গিয়ে থাকবে। বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তির লড়াই বোকামি। তাই দেবাশিস একটু চুপ করে থাকে। একটা সিগারেট ধরায়।
বলে, দেখি।
দেখবে আবার কী! রবিকে আমার কাছে দিয়ে দাও। তোমার পায়ে পড়ি।
ওখান থেকে ওর ইস্কুলটা কাছে হয়, তা ছাড়া একভাবে থেকে থেকে সেট হয়ে গেছে, এখন তোর এখানে এসে থাকলে দেখবি ওর মন বসছে না।
কী কথা! এ বাড়িতে এলে ও কখনও যেতে চায় দেখেছ?
সে এক-দু দিনের জন্য, পাকাঁপাকিভাবে থাকতে হলেই গোলমাল করবে।
সে আমি বুঝব! তুমি বাপু ছেলেকে একেবারে সাহেব করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ। আজকাল আমার সঙ্গেও ইংরিজি বলে ফেলে, কথায় কথায় ‘সরি’ আর ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে।
শিশির গামছা ছেড়ে লুঙ্গি পরেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আসলে গরিবের বাড়িতে রাখতে দাদার ভয়। এখানে খারাপ সহবত শিখবে। খানা-পিনাও তেমন সায়েন্টিফিক হবে না।
দেবাশিস মনের মধ্যে এ সব কথাই ভাবে। এখানে দঙ্গলের মধ্যে পড়ে রবি তার আচার আচরণ ভুলে যাবে, স্মার্টনেস হারাবে। চিৎকার করতে শিখবে, খারাপ কথা বলতে শিখবে। এবং হয়তো বা দেবাশিসকে একটু একটু করে বিস্মৃত হবে।
দেবাশিস মৃদু গলায় বলে, না, সে সব নয়। আসলে ও আছে বলেই ফ্ল্যাটটায় ফিরতে ইচ্ছে করে।
ফুলি বলে, তুমি আর কতক্ষণের জন্যই বা ফেরো! রাতটুকু কেটে গেলেই তো আবার টো-টো কোম্পানি। ও যে একা সেই একা।
দেবাশিস একটা শ্বাস ফেলে বলে, ভেবে দেখি।
দাদা, আমি রবিকে বুক দিয়ে আগলে রাখব। একটুও চিন্তা কোরো না।
সে আমি জানি। তবু একটু ভেবে দেখতে দে। ভাবতে ভাবতেই ওকে শেষ করে ফেলো না। এখানে থাকলে ও সব ভুলে থাকতে পারবে। ফাঁকা ঘরে থাকে বলেই ওর সব মনে পড়ে। আমার কাছে কত কথা এসে বলে!
দেবাশিস ফুলির দিকে একটু অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে দেখছিল। ছেলেপুলের কী অপরিসীম সাধ ওর। গর্ভযন্ত্রণার কথা ভাবে না, ঝামেলার কথা ভাবে না! দুবার ওর পেটের ছেলে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে আজও দুঃখ করে। এই অভাব, দারিদ্র্য, দুঃসময়–এগুলো ওর কাছে ব্যর্থ হয়ে গেছে। দুটি বা তিনটি সন্তানের সরকারি বিজ্ঞপ্তি ও কখনও বোধ হয় চোখ তুলে দেখে না। শুনলে বলে, ও সব শোনাও পাপ।
দেবাশিস একটু হেসে বলে, পারিসও তুই!
ভিখিরির মতো ফুলি বলে, রবিকে দেবে দাদা?
দেবাশিস মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, আজ উঠি রে।
সে উঠে দাঁড়ায়। চাঁপা দৌড়ে গিয়ে রবিকে বলে, সোনাবাবু, এসো। বাবা চলে যাচ্ছে। দেখা করে যাও।
কিন্তু রবি সহজে আসে না। দেবাশিস সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। চাঁপা রবিকে হাত ধরে নিয়ে আসে। দেবাশিস দেখতে পায়, ইতিমধ্যেই রবিব চুল ঝাঁকড়া হয়ে গেছে। গায়ের টি-শার্ট বুক পর্যন্ত গুটিয়ে তোলা। মুখে চোখে একটা আনন্দের বিভ্রান্তি। দেবাশিসের দিকে চেয়েই রবি দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলল, বাবা তুমি যাও।
দেবাশিস ক্লিষ্ট একটু হাসে। বলে, আচ্ছা।
ফুলি সিঁড়ি পর্যন্ত আসে। কয়েক ধাপ নামে দেবাশিসের সঙ্গে। গলা নিচু করে বলে, শোনো দাদা।
দেবাশিস অন্যমনস্কভাবে বলে, উঁ।
রবি তোমার কাছে থাকলে ক্ষতি হবে। ও বড় দুঃখী ছেলে। তুমি কেন বুঝতে পারছ না?
দেবাশিস হাসল। মড়ার মুখের মতো হাসি। তারপর ফুলিকে পিছনে ফেলে নেমে এল রাস্তায়।
গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে একটা কণ্ঠস্বর শুনে হঠাৎ ওপরে তাকাল। চমকে উঠল ভীষণ। দোতলার রেলিঙের ওপর দিয়ে আধখানা শরীর বাড়িয়ে বাঁকে আছে রবি। আশেপাশে পিসতুতো ভাইবোনেরা। খুব উত্তেজিতভাবে কী যেন দেখছে দূরে। হাত তুলে আঙুল দিয়ে পরস্পরকে দেখাচ্ছে। হয়তো কাটা ঘুড়ি। কিংবা হেলিকপ্টার।
দেবাশিসের বুকের ভিতরটায় প্রবল একটা ঝাঁকুনি লাগে! গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলে যেমন হয়।
রবি! বলে একটা চিৎকার দেয় সে।
মস্ত ভুল হয়ে গেল চিৎকারটা দিয়ে। এমন অবস্থায় কাউকে ডাকতে নেই। রবির মা সাততলা ফ্ল্যাট থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়।
শরীরের আধখানা বাইরে ঝুলন্ত অবস্থায় রবি ডাকটা শুনতে পেয়ে চমকে উঠল। দুলে উঠল শিশু-শরীর। শূন্য হাত বাড়িয়ে একটা অবলম্বনের জন্য অসহায়ভাবে হাত মুঠো করল৷ টালমাটাল ভয়ংকর কয়েকটি মুহূর্তের সন্ধিসময়। দেবাশিসের প্রায় সংজ্ঞাহীন শরীরটা টাল খেয়ে গাড়ির গায়ে ধাক্কা খায়। চোখ বুজে ফেলে সে। দাঁতে দাঁত চাপে।
রবি সামলে গেল। ওর ভাইবোনেরা ওকে ধরেছে। টেনে নামিয়ে নিচ্ছে রেলিং থেকে! ফুলি এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে।